… … …
এই সময়কে মনে রেখে তিনটি পোস্টার
… … …
… … …
… … …
‘কার্টুনপত্তর’ নামে এই ই-পত্রিকাটি শুরু হয়েছিল কার্টুন, বিশেষত বাংলা কার্টুন, তার সঙ্গে অন্য অন্য ভাষার, অন্য অন্য দেশের কার্টুন দেখা জানা আর বোঝার জন্য।
বাংলা কার্টুন নিয়ে গবেষণার কাজ করতে গিয়ে সংগ্রহ করা হয়েছিল কার্টুন। নানা পত্রপত্রিকা থেকে, বই থেকে, সংগ্রহশালা থেকে, নিজস্ব সংগ্রহ থেকে, গ্রন্থাগার থেকে। সেই দিয়ে শুরু, আজ থেকে বছর-ছয়েক আগে।
চিত্রকলা নিয়ে পণ্ডিতি আলোচনায় কার্টুন অবহেলিত। সেই অবহেলার একটা জবাব দেওয়ার চেষ্টা করে গেছে ‘কার্টুনপত্তর’।
নানা ধরনের কার্টুন, নানা শিল্পীর আঁকা, নানা মাধ্যমে প্রকাশিত, মুদ্রিত, নানা উদ্দেশ্যে বানানো কার্টুন। কার্টুনের পত্রিকা, পত্রিকায় কার্টুন, কার্টুনের বই, বইয়ে ছাপা কার্টুন, কার্টুন নিয়ে লেখা, কার্টুনের খবর, নানান কারণে আঁকা কার্টুন রাখা হয়েছে এখানে।
‘কার্টুনপত্তর’ সময়ের পথ ধরে ক্রমে কার্টুনের এক মহাফেজখানা হয়ে উঠেছে। জনপ্রিয় হয়েছে, অনেক দর্শক ও পাঠক পেয়েছে।
কার্টুনের মতোই আর-এক অবহেলিত শিল্প পোস্টার।
বাংলা কার্টুন নিয়ে গবেষণার পর বাংলা পোস্টার নিয়ে কাজ শুরু করা। কার্টুনের মতোই পোস্টারও মূল্যবান শিল্পসম্পদ। এবার কার্টুনের মতোই একই পরিসরে পোস্টার দেখা, জানা আর বোঝার চেষ্টা।
‘কার্টুনপত্তর’ কার্টুনের পাশাপাশি পোস্টারের জন্যও জায়গা করে দিল। আন্তর্জাল ঠিকানা একই থাকলেও এই ই-পত্রের নাম এখন থেকে ‘কার্টুন আর পোস্টার’।
বাংলা কার্টুনের মতোই বাংলা পোস্টারেরও মহাফেজখানা হয়ে ওঠার ইচ্ছে এই ই-পত্রের। পণ্ডিতি অবহেলার শিকার দুই শিল্পমাধ্যমের আধার হয়ে উঠুক এই ই-পত্র।
… … …
অহিংসা, কার্ল ফ্রেডরিক, রয়টার পুরস্কার, ২০১৯
… … …
5th May, World Cartoonists’ Day
… … …
গগন ঠাকুর
… … …
কার্টুনশিল্পী গ্রেফতার
তামিলনাড়ুর কার্টুনশিল্পী জি বালা-কে ৫ নভেম্বর ২০১৭ গ্রেফতার করেছে। তাঁর অপরাধ একটি কার্টুন এঁকে প্রকাশ করা।
কার্টুনটির একটা পটভূমি আছে।
তামিলনাড়ুর তিরুনেলভেলি জেলার কালেকটরেটের সামনে ২৩ অক্টোবর একজন চাষি তাঁর স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে নিজেদের গায়ে আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যা করে। পরিবারটিকে এক মহাজন অতিষ্ঠ করে তুলেছিল। তাঁরা কালেকটরেটের কাছে কিছু করার জন্য ৬ বার আবেদন করেছিল। কিন্তু সেখান থেকে কোন ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি। তামিলনাড়ুতে কিন্তু মহাজনি প্রথার বিরুদ্ধে আইন আছে।
আত্মহত্যার এই ছবি তামিলনাড়ু জুড়ে ব্যাপক সাড়া ফেলে। জি বালা এই ঘটনার প্রতিবাদে ফেসবুকে একটি কার্টুন পোস্ট করেন। সেখানে মুখ্যমন্ত্রী, কালেকটর এবং পুলিশ কমিশনারকে দেখা যায় চাষিটির পুড়ে-যাওয়া শরীরের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে, তাঁদের নগ্নতা তাঁরা টাকার বান্ডিল দিয়ে আড়াল করতে ব্যস্ত। সামাজিক মাধ্যমে ছবিটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। প্রকাশের প্রায় তিন সপ্তাহ পরে মুখ্যমন্ত্রী শিল্পীকে গ্রেফতারের নির্দেশ জারি করেন।
তিরুনেলভেলি থেকে প্রায় ৬০০ কিমি পথ পেরিয়ে পুলিশ মধ্যরাতে বালা-কে গ্রেফতার করে। তাঁর আত্মীয়দের কিছুই জানানো হয় না, বালা-কেও কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে দেওয়া হয় না। পরে জানানো হয় ইন্ডিয়ান পেনাল কোডের ৫০১ ধারা অনুযায়ী মানহানি এবং আইটি অ্যাকটের ৬৭ ধারা অনুযায়ী অশ্লীলতার অভিযোগে বালা-কে গ্রেফতার করা হয়েছে। বলা হয়নি, এ দুটি ধারা কী ভাবে তাঁর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
সারা তামিলনাড়ু জুড়ে প্রতিবাদ চলছে। ‘কার্টুনপত্তর’ও এই গ্রেফতারির প্রতিবাদ করছে।
… … …
দেবীপক্ষের সূচনায় শিবশঙ্কর দাসের কার্টুন
স্বাধীনতা দিবসের কার্টুন : রাজেশ পাল
‘কার্টুনপত্তর’-এর এক বন্ধু নোটবাতিলের অর্থনীতি নিয়ে এই কার্টুনটি আমাদের পাঠিয়েছেন। তিনি তাঁর নাম জানাতে চান না। আমরা তা এখানে রাখলাম ‘কার্টুনপত্তর’-এর বন্ধুদের জন্য।
… … …
… … …
সূত্র : এই সময়, ২ নভেম্বর, ২০১৬
… … …
সরকার এনডি টিভি-র হিন্দি চ্যানেল এক দিনের জন্য বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছে।
‘কার্টুনপত্তর’ তার সংগ্রহ থেকে রেবতীভূষণের অনেক কাল আগে আঁকা এই কার্টুনটা আজ রাখল।
সরকার বদলে যায়… সরকারের নির্দেশ… সরকারের চরিত্র বদলায় না।
… … …
অবনীন্দ্রনাথের কার্টুন
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা এই ছবিটি কয়েকটি খোপে ভাগ করা। উপরে একটি খোপে কার টেগোর অ্যান্ড কোম্পানি। অবনীন্দ্রনাথের পূর্বপুরুষ দ্বারকানাথের কোম্পানি। সেখানে সাহেব-মেমদের সঙ্গে মদ্যপান করছেন একজন সম্ভান্ত্র বাঙালি। খাবার টেবিলে প্লেট ও কাঁটা-চামচ সাজানো। সঙ্গে পরিবেশন-কর্মী। বাড়িটির মাথায় ব্রিটিশ পতাকা। বাঁদিকে নিচের খোপে একটি দর্জির দোকান। সেলাই কল রাখা। কাউকে শায়িত অবস্থায় রেখে পোশাক বানানো চলছে। একজন মহিলা তার পিঠ টিপে দিচ্ছেন। তার নিচের খোপে জানলায় একটি মুখ। একটি মুসলমান লোক। ডানদিকের নিচের খোপে এক হিন্দুর মুখ। পরিচিত চিহ্নে ব্যবসায়ী। তার উপরে গুদামঘর। জমিয়ে রাখা পণ্য। সব মিলিয়ে সেই সময়কার কলকাতার ছবি। কার্টুন-ছবি।
… … …
‘কার্টুনিস্ট’ রবীন্দ্রনাথ?
বিশ্বভারতী কোয়ার্টারলি-র নভেম্বর ১৯৩৮ (ভলিউম ৪, পার্ট ৩) সংখ্যায় বেরিয়েছিল রবীন্দ্রনাথের আঁকা এই ছবিটি।
ছবির নাম ‘ইউরোপিয়ান পলিটিক্স?’ ছবিটি দুই বিশ্বযুদ্ধের মাঝখানের সময় নিয়ে আঁকা, যখন ইউরোপের দেশগুলো একে অপরের বিরুদ্ধে, ছবিতে রবীন্দ্রনাথ তা নিয়ে ব্যঙ্গ করেছেন।
তিনটি চরিত্র, পরনে ইউরোপীয় পোশাক, একে অপরকে লাঠি মারছে, ঘুসি মারছে। ছবির রঙ কালো ও ধূসর, শরীর ও মুখ কার্টুনের ঢঙে আঁকা।
… … …
গত ৫ মে ছিল বিশ্ব কার্টুন দিবস। এই দিনে স্মরণ করি তাঁকে, যিনি প্রথম কার্টুন এঁকেছিলেন, লিখেছিলেন, ছাপিয়েছিলেন অমৃতবাজার পত্রিকায়। ২৮ ফেব্রুয়ারি, ১৮৭২। তাঁর নাম জানতে পারিনি। এমন দিনে শ্রদ্ধা জানাই তাঁকে।
… … …
এই কার্টুনটি সুরেন্দ্র-র আঁকা। বেরিয়েছিল ‘দ্য হিন্দু’ পত্রিকায়, ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬। প্রধানমন্ত্রীর সমালোচনায় আঁকা কার্টুনটি ব্যবহার করেন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী তাঁর টুইটারে। এ জন্য সমালোচিত হন তিনি। তাঁকে সমালোচনার কারণ, কার্টুনটির একটি চরিত্রের সঙ্গে হনুমানের মিল। ফলে যারা হনুমানপন্থী বা হনুমানবাদী, তাদের ভাবাবেগে আঘাত লেগেছে। এই কার্টুন প্রচার করে দিল্লির মুখমন্ত্রী হনুমানদেবকে অপমান করেছেন।
… … …
যারা ক্ষমতায় বসে আছে, তারা অন্যদেরকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে, ছোট করে, ব্যঙ্গ করে৷ ব্যঙ্গ করে কার্টুন আঁকে। কার্টুন তখন ক্ষমতাসীনের হাতে। অস্ট্রেলিয়ার একটি পত্রিকায় একটি কার্টুন ছাপা হয়েছে সম্প্রতি ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি একটা সময়ে। কয়লা পুড়িয়ে তাপবিদ্যুৎ বানিয়ে পৃথিবী গরম হয়ে যাচ্ছে, পৃথিবীর ক্ষতি হচ্ছে। তার বদলে সূর্যের তাপ থেকে বিদ্যুৎ বানানোর কথা আসছে। সেই প্রকল্পে ভারতে, ভারতের মতন দেশগুলিতে সৌরবিদ্যুৎ বানানোর যন্ত্রপাতি পাঠানো হবে। তাই নিয়ে ব্যঙ্গ করা অস্ট্রেলিয়ার কাগজে ছাপা কার্টুনে। এঁকে বলা ভারতবাসীরা এত দরিদ্র, এত অশিক্ষিত যে সৌরবিদ্যুতের জন্য পাঠানো যন্ত্রপাতি গুঁড়ো করে চিবিয়ে খাবে। শাদা চামড়ার দেশগুলোর কালো বা বাদামি রঙের মানুষদের সম্পর্কে এমন ধারণা, সাম্রাজ্যবাদী শাসনকাল থেকে চলে আসছে।
… … …
এই কার্টুনটি প্রসঙ্গে এসেছে আর একটি কার্টুনের কথা। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক টাইমস্ কাগজে ছাপা হওয়া একটি কার্টুন। ভারত তার মহাকাশ গবেষণা প্রকল্পে মঙ্গলগ্রহের চারপাশে ঘুরে বেড়িয়ে তথ্য সংগ্রহের জন্য একটি উপগ্রহ পাঠিয়েছিল। তাকে ব্যঙ্গ করে কার্টুনটি বানানো হয়। দেখানো হয় বড়লোক হয়ে থাকা দেশগুলি যারা মনে করে মহাকাশ গবেষণা শুধু তাদেরই বিষয়, তাদের এলিট ক্লাবের দরজার সামনে ভারত, ভারত বলতে পোশাকে দরিদ্র একজন, যার হাতে গরু। ভারত বলতে যা সাম্রাজ্যবাদীরা, বড়লোক হয়ে থাকা দেশগুলি বুঝে থাকে। এই বুঝে থাকা আসলে বর্ণবৈষম্যের প্রকাশ। বোঝার শাদা-কালো ভাগ। কালোদের বিষয়ে শাদাদের বোঝা। যা কালোদের দেশে শাদাদের সাম্রাজ্যবাদী শাসনকাল থেকে চলে আসছে।
… … …
ছত্তিশগড় রাজ্যের বস্তার অঞ্চলে দু’জন সাংবাদিককে গ্রেফতার করা হয় এই অভিযোগে যে, তাদের সঙ্গে মাওবাদীদের যোগাযোগ আছে৷ এর বিরুদ্ধে সাংবাদিকরা প্রতিবাদ জানান৷ কার্টুনচিত্রী অসীম ত্রিবেদী সাংবাদিকদের প্রতিবাদের পক্ষে দশটি কার্টুন আঁকেন৷ (10 Cartoons supporting journalists’ movement in Bastar-India : http://www.bandw.in/2015/12/10-cartoons-supporting-journalists.htm) সাংবাদিকদের প্রতিবাদের পরের দিন ত্রিবেদীর আঁকা কার্টুনের বিপক্ষে হোয়াটস্ অ্যাপ গ্রুপে এবং ফেসবুকে কয়েকটি কার্টুন পাঠানো হয়৷ কার্টুনচিত্রীর নাম দেওয়া হয় না৷ কার্টুনে দেখানো হয় সাংবাদিকরা মাওবাদীদের বন্ধু, বিদ্রোহীদের সমর্থক৷ সাংবাদিকরা মনে করেন, এই কার্টুনগুলি পুলিশের তরফে আঁকা৷ সাংবাদিক কমল শুক্লা যিনি সাংবাদিক দু’জনের মুক্তির আন্দোলনের নেতৃত্বে, তাঁর বক্তব্য এই সাংবাদিক-বিরোধী কার্টুনগুলি বানানো হয়েছে অসীম ত্রিবেদীর কার্টুনের বিরোধিতায়৷ তিনি এই কার্টুনগুলি প্রচারের জন্য বস্তারের ইন্সপেক্টর জেনারেলকে অভিযুক্ত করেছেন৷ পুলিশকর্তা এর কোন জবাব দেয়নি৷ প্রথমে এই কার্টুনগুলি সুকমা জেলার একজন পুলিশ অফিসার কয়েকটি হোয়াটস্ অ্যাপ গ্রুপে পোস্ট করে৷ সেই অফিসার পরে বলেছে এই কার্টুনগুলি সে আঁকেনি, অন্য কাউকে আঁকতে বলেনি৷ ছত্তিশগড় বিধানসভায় বিষয়টি ওঠে৷ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জবাব দেয়৷ সাংবাদিকরা, তাদের ইউনিয়ন জবাবে সন্তুষ্ট হননি৷
… … …
কার্টুন-চিত্রীরা এখনও ‘দলিত’?
এই বছর কার্টুন চিত্রকর আর কে লক্ষ্মণ প্রয়াত হওয়ার পর মহারাষ্ট্র সরকার ঘোষণা করেছিল লক্ষ্মণের স্মরণে কিছু একটা করবে। অক্টোবর মাসের শেষ দিকে সরকার জানায় মুম্বাইয়ে শিল্প শিক্ষা ও চর্চার প্রতিষ্ঠান স্যার জে জে ইন্সটিটিউট অফ অ্যাপ্লায়েড আর্ট-এ লক্ষ্মণ সম্মাননায় একটি মিউজিয়াম বানানো হবে, যেখানে তাঁর আঁকা কার্টুন স্থায়ী ভাবে প্রদর্শিত হবে।
সরকারের এই ঘোষণায় মহারাষ্ট্রের বিভিন্ন আর্ট সোসাইটি আপত্তি জানিয়েছে। আপত্তির কারণ : জে জে স্কুলের সঙ্গে লক্ষ্মণের কোন যোগাযোগ ছিল না। এখানে ছোট করে বলে রাখা যায়, ১৯৩০-এর দশকের শেষ দিকে লক্ষ্মণ এই স্কুলে ছবি আঁকা শিখতে চেয়ে ভর্তি হতে পারেননি। তাঁর কাজ ভর্তি হওয়ার পক্ষে প্রয়োজনীয় মানের ছিল না।
দি আর্ট স্কুল অফ ইন্ডিয়া-র সেক্রেটারি জানিয়েছেন, লক্ষ্মণের ছবি স্থায়ী ভাবে প্রদর্শিত হলে লক্ষ্মণের আগের খ্যাতনামা শিল্পীদের প্রতি অন্যায্য ব্যবহার করা হবে। কারণ তাঁদের ছবি প্রদর্শিত হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। বোম্বে আর্ট সোসাইটিরও একই বক্তব্য। বিখ্যাত শিল্পীদের প্রায় তিন হাজার ছবি জমে আছে, প্রদর্শিত করা যায়নি। সোসাইটির সম্পাদক বলেছেন, যদি একটি মিউজিয়ামে একজন কার্টুনিস্টের ছবি রাখা হয়, এবং অন্যান্য প্রখ্যাত শিল্পীদের ছবি না রাখা হয়, তা হলে শিল্প-শিক্ষার্থী ও শিল্পানুরাগীদের বঞ্চিত করা হবে।
এই খবরটি প্রকাশিত হয় ‘দি হিন্দু’ পত্রিকার ২৮ অক্টোবর, ২০১৫। পরদিন বিষয়টি নিয়ে ‘হিন্দু’তে কার্টুনচিত্রী সুরেন্দ্রর আঁকা একটি কার্টুন প্রকাশিত হয়।
আমরাও মনে করি নামজাদা শিল্পীদের ছবি স্থায়ী ভাবে প্রদর্শিত হোক। তবে যেহেতু তাঁদের বেলায় তা করা যাচ্ছে না, অতএব একজন কার্টুনচিত্রীরও স্থায়ী প্রদর্শশালা করা যাবে না, এমন যুক্তি আমরা বুঝে উঠতে পারছি না। বরং এ ঘটনায় কার্টুন-চিত্রকররা যে শিল্পপাড়ায় এখনও ‘দলিত’, এমন বোধই জোরদার হল।
… … …
শার্লি এবদো একটি বিতর্কিত ফরাসি ব্যঙ্গ পত্রিকা। পত্রিকাটি নিয়ে আবার বিতর্ক। বিতর্ক দুতি কার্টুন নিয়ে। কার্টুনের বিষয় সিরিয়া থেকে আসা শরণার্থী শিশু অ্যালান কুর্দির তুর্কি সমুদ্রসৈকতে পড়ে-থাকা মৃতদেহ। যে-মৃতদেহ, মৃতদেহের আলোকচিত্র সারা পৃথিবীকে ভাবিয়েছে শরণার্থী সমস্যা নিয়ে, সমস্যার সমাধান নিয়ে। এমন বিষয় নিয়ে দুটি কার্টুন ছাপা হয়েছে শার্লি এবদো-র সাম্প্রতিক সংখ্যায়।
একটি কার্টুন : শিশুটির মৃতদেহ, পাশে একটি বিজ্ঞপ্তি টাঙানো। তাতে লেখা : শরণার্থীরা তাদের লক্ষ্যের কত কাছে। বিশেষ সুবিধা ঘোষণা : একটি শিশুর দামে দুটি শিশুকে সুযোগ দেওয়া।
দ্বিতীয় কার্টুন : একটি লোক, খ্রিস্টের মতো দেখতে। লেখা : খ্রিস্টানরা যে জলের ওপর দিয়ে হাঁটতে পারে, তার প্রমাণ। জলে আংশিক ডুবে-থাকা শিশুটির কথা : মুসলমান শিশুরা ডুবে যায়।
কার্টুন-দুটির বিরুদ্ধে নানা মানুষজন মতামত দিচ্ছেন। কার্টুনচিত্রীর স্বাধীনতা মেনে নিয়েও বলা যায়, একটি শরণার্থী শিশুর মৃতদেহ কার্টুনের বিষয় হতে পারে না। কার্টুন-দুটিতে শিশুর মৃতদেহকে, শরণার্থী শিশুদেরকে, শরণার্থী মানুষদেরকে অপমান করা হয়েছে। ‘কার্টুনপত্তর’ প্রতিবাদ জানাচ্ছে।
… … …
ইন্টারনেটে কার্টুন দেখানোর, কার্টুন দেখার অধিকার কেড়ে নিয়েছিল রাষ্ট্র। তথ্যপ্রযুক্তি আইন, ধারা ৬৬এ।
যারা মত প্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে, তাদের পক্ষ থেকে আবেদনকারীরা গিয়েছিলেন সুপ্রিম কোর্টে এই আইনটির বিরোধিতায়।
তাদের আবেদন শুনে সুপ্রিম কোর্ট এই বিতর্কিত আইনি ধারাটি বাতিল করে দিল। ২৪ মার্চ, ২০১৫। এই ধারা অনুযায়ী ইন্টারনেটে ‘আপত্তিকর’ বা ‘ক্ষতিকারক’ মন্তব্য করার জন্য (যার মধ্যে কার্টুন-ও পড়ে) যে-কাউকে গ্রেপ্তার করার অধিকার ছিল পুলিশের। এই ‘আপত্তিকর’ ও ‘ক্ষতিকারক’ শব্দ-দুটির কোন স্পষ্ট ব্যাখ্যা ছিল না আইনে। অনেক সময়ে সরকার বা রাজনৈতিক দলের প্রতিহিংসা মেটানোর প্রায় হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল আইনটি। কখনও সাধারণ সমালোচক, কখনও কার্টুনচিত্রী বা কার্টুনের পরিবেশক হয়ে উঠেছিল ক্ষমতাসীনদের নিশানা।
সুপ্রিম কোর্টের বিচারক জে চেলামেশ্বর ও আর এফ নরিম্যানের বেঞ্চ পরিষ্কার জানিয়েছেন ৬৬এ ধারাটি অসাংবিধানিক। অতএব বাতিল।
এই ৬৬এ ধারার দু’জন ভুক্তভোগী অম্বিকেশ মহাপাত্র ও অসীম ত্রিবেদী। অম্বিকেশ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, মুকুল রায় ও দীনেশ ত্রিবেদীকে নিয়ে একটি কার্টুন ইন্টারনেটে ফরওয়ার্ড করার দায়ে ২০১২ সালে গ্রেপ্তার হন। অসীম ত্রিবেদীকে সংসদ ও সংবিধানের সমালোচনা করে কার্টুন আঁকার জন্য ‘দেশদ্রোহে’র অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়। অসীম ত্রিবেদীর অভিযুক্ত সব কার্টুন দেখার জন্য ব্যবহার করুন এই লিঙ্ক-টি: http://cartoonsagainstcorruption.blogspot.in।
এই বিষয়ে ‘কার্টুনপত্তরে’র জন্য বিশেষ ভাবে দুটি কার্টুন এঁকে দিয়েছেন ‘কার্টুন দলে’র ঋতুপর্ণ বসু।
সম্পাদকীয় : আক্রান্ত কার্টুন, কার্টুনশিল্পী, আবার
ক্ষমতাসীনরা সমালোচনা সহ্য করে না। কার্টুন সমালোচনা করে। ক্ষমতাসীনরা কার্টুন পছন্দ করে না।
ক্ষমতার নাম রাজা, ধর্ম-সংগঠন, সরকার, সরকারি প্রতিষ্ঠান, নির্বাচিত প্রতিনিধি, মন্ত্রী, দলনেতা। এই রকম, এমন সব এরা।
ইউরোপ, পঞ্চদশ শতকের প্রথম ভাগ। ধর্ম-প্রতিষ্ঠান চার্চ, প্রতিষ্ঠান-প্রধান পোপ, প্রতিষ্ঠান সদস্য ধর্মযাজকদের অসীম ক্ষমতা, বিলাসিতা, ব্যভিচার। ধর্ম-প্রতিষ্ঠান প্রধানের বিরুদ্ধে আন্দোলন। আন্দোলনে কার্টুনশিল্পী। লুকাস ক্রনোচ পোপকে আঁকলেন গাধা, বাছুর দেখিয়ে। পোপ রুষ্ট। ধর্ম-প্রতিষ্ঠান প্রচার করল লুকাস ঈশ্বর-বিদ্বেষী।
পরাধীন ভারত। বিদেশি শাসন। শাসকের অত্যাচারের সমালোচনায় দেশি সংবাদপত্র, সংবাদপত্রে প্রকাশিত কার্টুন। শাসকের অপছন্দ। সংবাদপত্র শাসনে, পরোক্ষে কার্টুন-শাসনে সংবাদ শাসনবিধি নানা সময়ে। ১৮১৮, ১৮২৩, ১৮৫৭, ১৮৭৮, ১৮৮৯, ১৯১০, ১৯৪০।
ফ্রান্স। ফরাসি বিপ্লব-উত্তর সময়। রাজা লুই ফিলিপ। অরাজকতা, অভিজাত শ্রেণির বিলাসিতা, শাসক শ্রেণির শোষণ। প্রতিবাদে কার্টুন-চিত্রী শার্ল ফিলিপঁ। ফিলিপঁ আঁকলেন চারটে ছবিতে, রাজার মুখ বদলে-বদলে নাসপাতি। রাজা রেগে গেলেন। ফরাসি ভাষায় ‘নাসপাতি’ শব্দের আরেক মানে ‘মাথামোটা’। রাজদ্রোহের অভিযোগে ফিলিপঁ কারাবন্দি। দ্যমিয়ের রাজাকে আঁকলেন ‘গারগাঁতুয়া’ চেহারায়, যার মানে ‘অর্থপেটুক দৈত্য’। দ্যমিয়ের-এর কারাদণ্ড। শুধু কার্টুনিস্ট নয়, কার্টুনও নিষিদ্ধ। পত্রিকা ‘লা কারিকাতুর’-এর বিরুদ্ধে মামলা। এক বছরে ৫৪টি। পত্রিকা বন্ধ।
জার্মানি। কাইজার ভিলহেলম-এর সমালোচনা করায় ‘সিমপ্লিসিজিমাস’ পত্রিকার সম্পাদক কারাগারে আটক।
স্বাধীন ভারত। সংবাদ শাসন। ১৯৫১-তে প্রেস (আপত্তিকর বিষয়) বিল সংসদে পেশ, ১৯৬২-তে ভারত-চিন যুদ্ধ ও ১৯৬৫-তে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ-কালে ভারত রক্ষা আইন, ১৯৭৫-এ জরুরি অবস্থায় সংবাদপত্র সেন্সরশিপ, সংবাদপত্রের কার্টুন সেন্সরড।
কার্টুন-চিত্রী আর কে লক্ষ্মণ। কাজ করতেন বোম্বাইতে। রোজ কার্টুন দিল্লিতে পাঠানো হত। সেন্সর করার জন্য। একদিন প্রেস সেন্সরশিপ দপ্তর থেকে শমন। সতর্ক করে দেওয়া। যদি কার্টুনে সরকারের সমালোচনা বন্ধ না হয়, গ্রেপ্তার করা হবে। জেলে আটকে রাখা হবে।
পরাধীন ভারত। মাদ্রাজ। ভারতীয় পত্রিকা ‘ইন্ডিয়া’। পত্রিকায় কার্টুন ছাপা হত। শাসকের নজরে কার্টুন। ক্রিমিনাল ইন্টেলিজেন্স ডিপার্টমেন্ট-এর নেটিভ নিউজপেপার রিপোর্ট-এ কার্টুন নিয়ে সংক্ষিপ্ত বিবরণ রেখে দেওয়া হচ্ছে। অ্যাডভোকেট জেনারেল, গভর্নমেন্ট অফ মাদ্রাজ-এর প্রস্তাব অনুযায়ী ‘ইন্ডিয়া’র বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের। অভিযোগের ভিত্তি একটি কার্টুন। বিচারকরা দোষী সাব্যস্ত করল সম্পাদককে।
ভারত। ২০১২। কার্টুন-চিত্রকর অসীম ত্রিবেদীর বিরুদ্ধে, তার আঁকা কার্টুনের বিরুদ্ধে শাসকদের অভিযোগ। অভিযোগের আইনি ধারা আইপিসি ১২৪, অর্থাৎ রাষ্ট্রদ্রোহিতা।
ভারত। তামিলনাড়ু। ‘আনন্দ বিকাতন’ পত্রিকার কার্টুনে রাজনৈতিক নেতারা অস্ত্রধারী দুর্বৃত্তদের সঙ্গে মঞ্চে বসে আছেন। শাসক দলের নেতারা রেগে গেলেন। কার্টুনিস্ট ও সম্পাদক গ্রেপ্তার।
ভারত। উত্তরপ্রদেশ। লখনৌ। স্থানীয় পত্রিকায় কার্টুন-চিত্রী মঞ্জুলের কার্টুন বিজেপি নেতা আদবানি-কে নিয়ে। কানপুরের বিজেপি নেতা অখুশি। কাগজ পুড়িয়ে দেওয়া হল। পত্রিকার কানপুর দপ্তর ঘেরাও করা হল।
উত্তরপ্রদেশ। ক্ষমতায় সমাজবাদী পার্টি। মুখ্যমন্ত্রী মুলায়ম সিং যাদবের পেশীশক্তিধারীদের নিয়ে কার্টুন মঞ্জুলের। তথ্য দপ্তরের নির্দেশ নেতাদের নিয়ে কার্টুন ছাপানো চলবে না। কার্টুনশিল্পীকে লখনৌ ছেড়ে চলে যেতে হবে।
ভারত। পশ্চিমবঙ্গ। কার্টুনশিল্পী চণ্ডী লাহিড়ীর সরকার-প্রদত্ত সাংবাদিক পরিচয় বাতিল। মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু চণ্ডী লাহিড়ীর আঁকা কার্টুনে ক্ষুব্ধ।
পশ্চিমবঙ্গ। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অম্বিকেশ মহাপাত্র প্রচারিত কার্টুনে ক্ষুব্ধ। মুখ্যমন্ত্রীর দলের কর্মীরা তাঁকে আক্রমণ করেছে, পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করেছে। মুখ্যমন্ত্রীর সিআইডি যেখানে কার্টুনটি প্রকাশিত হয়েছে, তাদের বলেছে ঐ কার্টুন এবং মুখ্যমন্ত্রীকে নিয়ে বানানো অন্যান্য কার্টুন মুছে দিতে। এবং আলোচ্য কার্টুন ছাড়া যারা অন্য-অন্য কার্টুন ছাপিয়েছে, তাদের নাম জানিয়ে দিতে, যাতে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া যায়। মুখ্যমন্ত্রীর দলের অধ্যাপকরা সাংবাদিকদের ডেকে বলেছেন, কার্টুনিস্টের কাজে তাদের মাথা হেঁট হয়ে গেছে। মুখ্যমন্ত্রীর কাছের একজন চলচ্চিত্র পরিচালক অর্থাৎ বুদ্ধিজীবী বলেছেন, কার্টুন-প্রচারককে আক্রমণ গণতন্ত্রের ওপর বা মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ কি না, তা নিয়ে মন্তব্য না-করাই ভালো।
কার্টুন-চিত্রকর ভিকি জার্মানি থেকে পালিয়ে আসেন ইংল্যান্ড-এ। সমাজতন্ত্রী। ইংল্যান্ড-এর রক্ষণশীলরা তাঁকে অপছন্দ করত। যুদ্ধের সময় তাঁর ওপর বিশেষ নজর রাখা হত। পঞ্চাশের দশকে তাঁর কার্টুন-সংকলনের নাম দিয়েছিলেন ‘ভিকি মাস্ট গো’। কার্টুনিস্ট ভিকি চলে যাও। ভিতরে ছবি এঁকেছিলেন ভিকিকে গিলোটিন করা হচ্ছে। কার্টুন-শিল্পীকে খুন করা হচ্ছে।
যা ক্ষমতাসীনরা চায়।
যা আমরা চাই না।
কার্টুন-আঁকিয়েরা দীর্ঘজীবী হোন।
কার্টুন-পরিচিতি
১। এখন বিসংবাদ, মে-জুলাই ২০১২, প্রচ্ছদে কার্টুন : বিস্ফোরক কার্টুনের খোঁজে, ঋতুপর্ণ বসু।
২। কুট্টি, বিষয় কার্টুন, কুট্টি সংখ্যা, পৌষ-ফাল্গুন ১৪১৩। তখন চালু-হওয়া মানহানি বিলের বিরোধিতায়। প্রতিবাদী হাতে, কার্টুন-আঁকা হাতে দড়ি বাঁধা।
৩। কাফী খাঁ, যুগান্তর, ২৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪০। দু-দিকে দুটি হাত ঘুসি পাকানোর ঢঙে, অন্য হাত আস্তিন গোটানো মারকুটে ঢঙে। এক হাতে লেখা ‘সরকারি’, অন্য হাতে লেখা ‘বেসরকারি’। একটা হাত ওপর দিকে মুঠো করা, অন্য হাত নিচের দিকে মুঠো করা। সম্পাদক টেবিলের নিচে, সামনে মাটিতে পড়ে খোলা কলম, কাগজের ওপর লেখা ‘সম্পাদকীয়’।
৪। কাফী খাঁ, যুগান্তর, ১৯৫৪। কাফী খাঁ সমগ্র, প্রথম খণ্ড, সম্পাদনা বিশ্বদেব গঙ্গোপাধ্যায়, প্রদীপ গরাই। সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ওপর সরকারি বিধিনিষেধ, পুলিশি জুলুম, কার্টুনে তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গের পুলিশমন্ত্রী কালীপদ মুখোপাধ্যায়।
৫। ভিকি-র কার্টুন সংকলনের প্রচ্ছদে পতাকা ধরে ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ম্যাকমিলান, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আইজেনআওয়ার, ফ্রান্স-এর প্রেসিডেন্ট দ্য গল, সোভিয়েত ইউনিয়ন-এর কম্যুনিস্ট পার্টি প্রধান ক্রুশচেভ।
. . .
১৯৯৫ সালের নির্বাচন। কংগ্রেস দলের মধ্যে ঝগড়াঝাটি। আমুল-এর বিজ্ঞাপন হোরডিং-এ কার্টুন। কংগ্রেস প্রতীক হাত নিয়ে কাড়াকাড়ি। দড়ি-টানাটানি। নির্বাচন কমিশন নিষেধ করে দেয় বিজ্ঞাপনটি টাঙাতে। হোরডিং-এ আঁকা কার্টুনের ওপর কালো রঙ লেপে দেওয়া হয়।
. . .
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে সেনাদলে যোগদান বাধ্যতামূলক। এর বিরুদ্ধে কার্টুন। দুই কার্টুনচিত্রী ইয়ং আর মাইনর-এর ‘দি মাসেস’ পত্রিকায়। সেনা, যার শুধুই শরীর, বলশালী শরীর। এবং যার মাথা নেই। একজন প্রকৃত সেনা। ‘অ্যাট লাস্ট আ পারফেক্ট সোলজার’। সরকারি নির্দেশকে ব্যঙ্গ করে এমন কার্টুন আঁকার অপরাধে পত্রিকার বিরুদ্ধে মামলা। পত্রিকার সরকারি ডাকব্যবস্থা ব্যবহার বাতিল করে দেওয়া। দুই কার্টুনচিত্রী ও সম্পাদককে গ্রেপ্তার। বন্ধ করে দেওয়া হল পত্রিকা।
. . .
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। হল্যান্ডের চিত্রকর লুই র্যামেকারস। জার্মানির যুদ্ধপ্রস্তুতি নিয়ে ব্যঙ্গ। কার্টুন ‘দি জার্মান ট্যাঙ্গো। যুদ্ধ আর মৃত্যু সমার্থক। জার্মানির সরকার ঘোষণা করেছিল কার্টুনশিল্পীকে ধরে আনতে পারলে পুরস্কার।
. . .
মোরারজি দেশাই মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী। রাজ্যে মদ্যপান নিষেধ করা হল। মোরারজি জানালেন তিনি এমনকী জলও পান করবেন না। তাঁর শরীর থেকে বেরনো জলই কেবল পান করবেন। তিনি ঘোড়দৌড় ও ক্রশওয়ার্ড পাজল-ও নিষেধ করে দেন। আর কে লক্ষ্মণ এই বিষয় নিয়ে একটি কার্টুন আঁকেন। মোরারজি মন্ত্রীসভার বৈঠক ডাকেন লক্ষ্মণের আঁকা বন্ধ করা এবং সরকার, রাজনীতি-করিয়ে, মন্ত্রী ইত্যাদি নিয়ে কার্টুন আঁকা নিষেধ করা নিয়ে আলোচনার জন্য। বৈঠকে তাঁকে জানানো হয়, এটি কঠিন কাজ। কারণ ভারতের সংবিধানে মত প্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষার কথা লেখা রয়েছে।
. . .
শিল্পী অজিত নাইনান। জেস্ট ইন টাইম : আ কাভালকাড অফ কার্টুনস ওভার ১৭৫ ইয়ারস (অফ টাইম্স অফ ইন্ডিয়া), টাইম্স গ্রুপ বুকস, ২০১৩।
সম্পাদকীয় : কার্টুন-কথা
‘কার্টুনপত্তর’ নামে এই ই-পত্রিকায় আবার অনেক লেখা, ছবি, সংবাদ ইত্যাদি যোগ হল। এ ভাবেই পরবর্তী কালে নতুন-নতুন লেখা, ছবি ইত্যাদি যোগ হতে থাকবে। পাঠক তার খবর পাবেন আমাদের ফেসবুক প্রোফাইল এবং পেজ-এ।
প্রথম প্রকাশের পর ‘কার্টুনপত্তর’ নিয়ে সাড়া পেয়েছি, মতামত পেয়েছি।
আমরা উৎসাহিত।
এই সংখ্যায় অন্যান্য অংশে যোগ হল অন্য দেশের কার্টুন।
আপনারা মতামত দিন। কার্টুন এঁকে পাঠান। কার্টুন সংগ্রহ করে পাঠান।
সম্পাদকীয় : পত্তর-কথা
‘কার্টুনপত্তর’ নিয়ে এটি একটি পত্র বা পত্তর, কার্টুনপত্তর নিয়ে পত্রিকা। ই-পত্রিকা। ছাপাখানায় না-ছাপানো পত্রিকা।
হাতে না-পাওয়া, চোখে দেখা।
এখন এই সময় যা হচ্ছে। অন্য-অন্য ভাষায়, অন্য-অন্য দেশে কার্টুন নিয়ে এমনটি হচ্ছে নিশ্চয়ই। বাংলায় হচ্ছে কি না, জানা নেই।
তেমনটি হলে আমরা আরও একটি বানালাম।
খুব বেশি দাবি নেই। আমাদের কার্টুন ভালো লাগে, কার্টুন যোগাড় করি, জমিয়ে রাখি, কার্টুন নিয়ে লিখি, কার্টুন আর লেখা ছাপাই, বই বানাই।
এ ভাবেই এই কার্টুনপত্তরটি বানানো, চোখে দেখতে-দেখতে পড়তে-পড়তে যদি মনে হয়, হাতে পেতে ইচ্ছে হচ্ছে,
হাতে ধরিয়ে দেওয়া যাবে, ছাপানো যাবে। তখন বের করা, দেখানো, পড়ানো।
কেমন লাগল জানাবেন। জানালে ভালো লাগবে। উৎসাহ পাব।
এ বারে এই অবধি। এই অব্দি কার্টুনপত্তরের কথা থাক। কার্টুনপত্তর নিয়ে কথা দেওয়া থাক।
‘কার্টুনপত্তর’-এর লোগো
‘কার্টুনপত্তরে’র এই লোগো আমরা ‘হরবোলা ভাঁড়’-এর প্রচ্ছদ থেকে নিয়েছি।
তার কারণ, ‘হরবোলা ভাঁড়’-ই হল বাংলায় প্রথম কার্টুন পত্রিকা।
দ্বিতীয়ত, এ ছবিতে দেখা যাচ্ছে : শিল্পী এখানে বাঁদর আঁকতে গিয়ে মানুষ এঁকে ফেলেছেন।
‘মানুষ আঁকতে গিয়ে বাঁদর এঁকে ফেলা’ প্রবাদবাক্যের উলটো এ ঘটনা বেশ মজার।
‘কার্টুনপত্তর’-এর লোগো-র মতই বিনয়কুমার বসুর এই কার্টুনটিও উল্টো ঘরানার।
এখানে শিল্পী একজন মহিলা। মডেল একজন পুরুষ। তখন বাস্তবে যা হত, তার উল্টো।
বিনয় বসু উল্টোটাই দেখাতে চেয়েছেন তার ‘মেয়েমহল’ বইয়ের কার্টুনগুলিতে।
এখানে তার একটি। ছবির নিচে সংলাপ। শিল্পী বলছেন : ‘আপনি পোজ দিতে জানেন না মশাই!
বেশ একটু লীলায়িত হয়ে…’। মডেল-এর উত্তর : ‘ওঃ! লীলায়িত! এই নিন।’
এ বার এই বিভাগের কার্টুনটি বেছে নেওয়া সাম্প্রতিক বিষয়ের সঙ্গে মিলিয়ে। এখানে দেখানো কার্টুনচিত্রী, কার্টুনের বিষয় আর কার্টুন— এই সম্পর্ক। দেখানো যে ক্ষমতাসীনরা তাদের কী ধরনের ছবি, তাদের নিয়ে কেমন ছবি আঁকাতে চায়, দেখাতে চায়। এই কার্টুনে ক্ষমতাসীন, ক্ষমতার পরিচিত চিহ্ন— হিটলার।
ছবি সংগ্রহের সূত্র : চণ্ডী লাহিড়ী, কার্টুনের ইতিবৃত্ত, গণমাধ্যম কেন্দ্র, ১৯৯৫
কার্টুনটি এঁকেছেন আর কে লক্ষ্মণ। কার্টুনে নিজেকেই এঁকেছেন, সঙ্গে কমন ম্যান আর কমন উওম্যান। এঁরা দেখছেন ক্ষমতা-কেন্দ্রের বাইরে ক্ষমতায় যেতে-চাওয়া, থাকতে-চাওয়া নেতাদের লাইন। কার্টুনের ভিতরেই তা লেখা। বিষয়টা এমনিতেই এত হাস্যকর যে কার্টুন আঁকার দরকার পড়ে না, কার্টুন এঁকে ব্যঙ্গ করারও প্রয়োজন নেই। তাই কার্টুনচিত্রী কার্টুন আঁকতে চাইছেন না। লক্ষ্মণের সামনে টেবিলের ওপর আঁকার বোর্ড, রং-তুলি, লক্ষ্মণ কার্টুন আঁকছেন না। আঁকতে চাইছেন না।
শিল্পীর হাতে, বাঁহাতে বিশাল প্যালেট, তাতে অনেক রঙ রাখা, রঙ দেখানো। সামনে ছবি আঁকার জন্য রাখা ক্যানভাসটি ছোট, খুবই ছোট। রঙের প্যালেটের তুলনায় বেশ ছোট, কোন মিল নেই। ক্যানভাসে কয়েকটি আঁচড়, মাত্র কয়েকটি।
রাষ্ট্র ‘ছবি’ আঁকে, এঁকে দেখায়, যতটা রঙ দেখায়, ছবি তত নয়। এই করব, এই করছি, এই বাজেটে এতটা রেখেছি, এই দিচ্ছি, এই দেব। দেবার বেলায় এইটুকুনি, এক চিমটে।
সরকারি স্বাধীনতা দিবসকে মনে রেখে এই কার্টুনটি। এঁকেছেন শৈল চক্রবর্তী, রেখেছেন তাঁর ‘কার্টুন’ নামের বইটিতে। বেরিয়েছিল বাংলা ১৩৫২-য়। ইংরাজি ১৯৪৫। স্বাধীনতা পাওয়ার আগে যা এঁকে দেখিয়েছেন, স্বাধীনতা বানিয়ে দেবার এত বছর বাদেও তা সত্যি। সাংঘাতিক সত্যি! কার্টুনীয় সত্যি!
রামকিঙ্করের আঁকা ছবি। শিল্পীর সামনে ক্যানভাস। পাশে মডেল। দুটি বেড়াল, খেলায় অথবা ঝগড়ায়। ক্যানভাসে আঁকা বেড়াল মডেল বেড়ালদের দিকে রাগত চোখে তাকিয়ে। সবাই বিধ্বস্ত ছবি আঁকা নিয়ে। শিল্পী, মডেল, যাকে ছবিতে আঁকা, সবাই। ‘কার্টুনপত্তরে’র লোগো।
… … …
আর কে লক্ষ্মণের আঁকা। মূর্তকে সামনে বসিয়ে বিমূর্ত এঁকে যাওয়া। মূর্ত জানে না সে বিমূর্ত হয়ে যাচ্ছে। যারা জানে, তারা বলতে পারছে না। সবটা মিলে কার্টুন। ‘কার্টুনপত্তরে’র লোগো।
… … …
এই কার্টুনটি এঁকেছেন মিশরের কার্টুনচিত্রী আলেকজান্ডার সারাভখিন। জন্ম ১৮৯৮, প্রয়াণ ১৯৭৭। এই কার্টুনটি আঁকা হয়েছে ১৯৬৫-তে। কার্টুনটির নাম Nahas Pasha (The Model) as seen by the art students. আমাদের সংগ্রহ-সূত্র একটি প্রবন্ধ Between Fine and Comic Art : On the Arab Page, লেখক Jonathan Guyer, প্রকাশিত হয়েছে Le Monde Diplomatique-এ, জানুয়ারি ২০১৭-য়।
সারাভখিন সংবাদপত্র ও সাময়িকপত্রে কার্টুন এঁকেছেন সেই ১৯৩০-এর দশক থেকে। তাঁর ব্যঙ্গের লক্ষ্য মিশরের নেতা আর আরব বিশ্বের রাষ্ট্রনেতারা।
এই কার্টুনে এক মডেলকে, এক উচ্চবর্গীয় চরিত্রকে ব্যঙ্গ করে আঁকছেন কার্টুন-চিত্রীরা। ব্যঙ্গের প্রকাশ ভিন্ন-ভিন্ন।
কার্টুনটিকে ‘কার্টুনপত্তর’-এর সঙ্গে মিলিয়ে রাখা, মিলিয়ে দেখা।
আনোয়ার চিত্রকর। অ্যান আর্টিস্ট অ্যাট ওয়ার্ক, ২০০৮