১
নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা এখন খবরের কাগজের প্রথম পাতাটার যে-চেহারা দেখতে পায়, আমাদের সময়ের সঙ্গে সেটা মেলে না। আমাদের আমলে প্রথম পাতায় ‘লিড নিউজ’-এর সঙ্গে নিয়মিত একটা-না-একটা কার্টুন থাকতই। সামাজিক-রাজনৈতিক বিভিন্ন বিষয়ের ওপর।… এখন, ইংরেজি-হিন্দি-বাংলা প্রায় কোনও কাগজেই প্রথম পাতায় নিয়মিত কার্টুন বেরয় না। কারণটা জানি না। তবে যে কারণেই হোক, পরিণতিটা আমার কাছে ভীষণ দুঃখবহ। অ্যাপলিটিকাল বলে তো সত্যিই কিছু হয় না। সব কাগজই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষে একটা রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ অনুসরণ করে। তা হলে আলাদা করে কার্টুনিস্টকে অভিযুক্ত করার কারণ কী? কোনও নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দল, বা রাজনৈতিক নেতাকে অবলম্বন করে কার্টুনিস্টের আঁকা ব্যঙ্গচিত্র যে বার্তা পৌঁছে দিতে চায়, একটি বলিষ্ঠ, সপাট রিপোর্টিং বা নিখুঁত তথ্য-তত্ত্ব সম্বলিত উত্তর-সম্পাদকীয় কি সেই একই বার্তা পৌঁছে দিতে চায় না? সে ক্ষেত্রে ঐ রিপোর্টার বা পোস্ট-এডিট লেখকের ওপরও নিষেধাজ্ঞার খড়গ নেমে আসা উচিত। তাই কি না? কিন্তু সেটা হয় না। হাড়িকাঠে মাথা যায় প্রধানত কার্টুনিস্টের। কেন তিনি অমন করে অমুকের ছবি এঁকেছেন, তমুক ঘটনাটাকে অমন রসালো করে ফেঁদেছেন? ইত্যাদি ইত্যাদি। এটা সুবিচার, না প্রহসন, আপনারাই বিচার করুন। নানা জায়গায় নানা সময়ে শুনেছি যে, খবরের কাগজের কর্তৃপক্ষ রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে খামকা অসদ্ভাব চান না বলেই ধীরে ধীরে খবরের কাগজের প্রথম পাতায় কার্টুনের গুরুত্ব… কমে গেল। যুক্তিটা যদি অবান্তর হয়, আমার তরফে কিছু বলার নেই। আর যদি এ কথার মধ্যে চার আনা হলেও ‘সত্যি’ থাকে, তবে আমি বলব কার্টুনের শক্তি ও সামর্থ্যের এর চেয়ে বড় প্রমাণ আর হয় না।…
আসলে যে কোনও প্রথম শ্রেণীর পলিটিকাল কার্টুন, অন্তত আমার মতে, একই সঙ্গে হার্ড নিউজ মেটিরিয়াল ও পোস্ট এডিট অ্যানালিসিসকে ধারণ করে থাকে। এর ইমিডিয়েট এফেক্ট অনেক বেশি। এবং কোনও কার্টুনিস্ট যদি সৎ ভাবে এই ভুমিকা পালন করতে পারেন, আমি বলব, তাঁর সঙ্গে দূতের মতো ব্যবহার করা উচিত। দূত যুদ্ধক্ষেত্র থেকে কত না মর্মান্তিক খবর বহন করে আনে। সে সব শুনে মাথায় রক্ত চড়ে যাওয়া স্বাভাবিক। তবু দূতকে প্রাণে মারার নিয়ম নেই। দূত অবধ্য। কার্টুনিস্টও কি অবধ্য হতে পারেন না?
অমল চক্রবর্তী, ‘ডোডো কিংবা ফিনিক্স’, রোববার, ১১ জুলাই, ২০১০
… … …
২
কার্টুনে মন্ত্রীদের কাজের সরাসরি সমালোচনা করা হয়। এর থেকে সাধারণ সংবাদপত্র পাঠকরা কেউ-কেউ প্রায়ই ভাবেন কার্টুনিস্টরা সম্ভবত আইনে ঊর্ধ্বে বা তারা ‘বিশেষ আইনে’র সুরক্ষা পান। ধারণাটি ভ্রান্ত। সংবাদপত্র, কার্টুনিস্ট, কেউই আইনের দ্বারা সুরক্ষিত নন। যে কোনও মন্ত্রী, সরকারি আমলা বা সাধারণ মানুষ… কার্টুনিস্টের নামে মামলা করতে পারেন এবং সাধারণ আইনেই তাঁর বিচার হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময়ে শাসকগোষ্ঠী সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ করতে গিয়ে সর্বাগ্রে কার্টুনিস্টকে শাস্তি দিয়েছে। প্রথম মহাযুদ্ধের আগে কাইজার ভিলহেলম বেশ কয়েকজন কার্টুনিস্টকে রাজদ্রোহী ঘোষণা করে জেলে পাঠিয়েছেন।…
কার্টুন ছাপালে সরকার চটে, শিল্পপতিরা অসন্তুষ্ট হন, অর্থাৎ বিজ্ঞাপন মার খায়। সে জন্য সুকৌশলে কার্টুন তুলে দেওয়া হচ্ছে। বাণিজ্যিক পত্রিকাগুলি ব্যবসা করতে নেমেছেন, তাঁরা ঝুঁকি নিতে চান না।… কার্টুনের স্থানে বিজ্ঞাপন ছাপলে পয়সা আসে। এই সরল হিসাব বৃহৎ সংবাদপত্রের মালিকদের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে।
বৃহৎ বাণিজ্যিক সংবাদপত্রে যে সব কার্টুন ছাপা হয় তাতে ধার থাকে না। মধ্যপন্থা অবলম্বন করে তারা চলেন।…
উত্তর-নব্বই খোলা বাণিজ্যনীতি কার্টুনের ক্ষতি করেছে। কোকা কোলার আগমনে ভারতের নিজস্ব ঠাণ্ডা পানীয়গুলি একে একে উঠে যাচ্ছে। কিন্তু কোকা কোলার ঢালাও বিজ্ঞাপনের লোভে মালিকরা তা নিয়ে কোনও কার্টুন ছাপেনি। মাল্টিন্যাশনালরা টিকে থাকে বিজ্ঞাপনের জোরে। অনেক ক্ষেত্রেই গুণগত মানের জন্য নয়। সংবাদপত্র সেই বিজ্ঞাপন ছেপে মাল্টিন্যাশনালদের বাণিজ্যের ও স্বদেশি শিল্পের উচ্ছেদের পথ প্রশস্ত করেন। কার্টুনিস্টরা মালিকদের বিজ্ঞাপনের স্বার্থে বড় কাগজে ছবি আঁকছেন। সত্য উদ্ঘাটন করছেন না।…
কার্টুনিস্টকে নির্ভর করতে হয় সংবাদপত্র সম্পাদকের দাক্ষিণ্যের উপর। তাঁকে খুশি করে তার পর বৃহৎ জনতার দরবারে কার্টুনিস্টকে হাজির হতে হয়। হিউমার এমনই সূক্ষ্ম বস্তু যে কার্টুনে কোথায় হিউমার রয়েছে, সেটা দর্শন মাত্রই বুঝতে না পারলে হাজার ব্যাখ্যা করেও পরে বোঝানো যায় না। বার্তা সম্পাদক বা সম্পাদক যদি নিজের উন্নত রসবোধের দ্বারা কার্টুন বুঝতে না পারেন, তা হলে বৃহত্তর পাঠকের কাছে পৌঁছনোই যাবে না। কারণ কার্টুন তো ছাপাই হবে না।
চণ্ডী লাহিড়ী, কার্টুনের ইতিবৃত্ত, গণমাধ্যম কেন্দ্র, ১৯৯৫
… … …
৩
আমার নামে ওয়ারেন্ট বেরিয়েছে।… পুলিশ গিয়েছে বাড়িতে।… নন বেলেবল অফেন্স, রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ। আমার বেশ কিছু কার্টুন নিয়ে ওদের আপত্তি। আন্না হাজারের অনশন চলার সময়ে মুম্বাইয়ের এমএমআরডিএ গ্রাউনডে যেগুলো দেখিয়ে আমি দুর্নীতির প্রতিবাদ করেছিলাম। পুলিশ আমায় গ্রেপ্তার করে।…
পুলিশ হেফাজতে থাকার অভিজ্ঞতা কহতব্য নয়।… আমাকে বার বার ওরা ‘দোষ’ স্বীকার করে লিখিত বয়ান দিতে বলেছে… দিইনি। কেন দেব? আমি আমার কাছে পরিষ্কার… আমি তো কোনও দোষ করিনি। কীসের রাষ্ট্রদ্রোহিতা!… আমি মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। আমি একজন কার্টুনিস্ট… আমার চোখে সমাজটা যেভাবে ধরা দেয়, সেটাই আমি ফুটিয়ে তুলি।… ফেসবুকে কার্টুন পোস্ট করার ‘অপরাধে’ অম্বিকেশ মহাপাত্রকে গ্রেপ্তার করার পরেই আমরা দিল্লিতে ইন্ডিয়া গেট-এর সামনে প্রতিবাদ করেছি।… আমার কার্টুন নিয়ে একটা ওয়েবসাইট তৈরি করেছিলাম, ২০১১ সালের ২৭ ডিসেম্বর সেটা নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়। এর পর আমি ‘সেভ ইয়োর ভয়েস’ শ্লোগান তুলে ইন্টারনেট সেন্সরশিপের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার চেষ্টা করছি। শুনেছি আমার কার্টুন নিয়ে রাজ্যসভাতেও বিতর্ক উঠেছে।… আমার রাগ, দুঃখ প্রকাশের একটা ক্ষেত্র আমার কার্টুন… আমি মনে করি স্বাধীন গণতান্ত্রিক দেশে (দেশদ্রোহিতা) আইনের কোনও প্রয়োজন নেই। ভারতে ব্রিটিশরা এই আইনটি তৈরি করেছিল স্বাধীনতা আন্দোলনকারীদের দমন করার জন্য… স্বাধীন দেশে এই আইন থাকবে কেন, বুঝি না! এ ধরনের আইন থাকলে জনগণের মত প্রকাশের ওপর এক ধরনের জুলুমবাজি তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়…।
অসীম ত্রিবেদী, সাক্ষাৎকার দেবশঙ্কর মুখোপাধ্যায়, বর্তমান, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১২