কাফী খাঁ
বন্ধুবর কুমারেশ ঘোষের অনুরোধে ভেবে দেখলাম, কার্টুনের বিষয়ে কিছু লেখা যেতে পারে, কেননা এ জিনিসটাকে ঠিক ভাবে যাচাই করে দেখা হয়নি। আমার মনে হয়, এ লাইনে আমার সহকর্মী বন্ধুরা এবং ভবিষ্যতে অন্যরাও এ লেখা থেকে কিছুটা প্রয়োজনীয় বিষয়ে হদিশ পাবে। তাই লিখচি।
কার্টুনের ইতিহাস ও বিকাশ ইত্যাদির বিরাট কচকচির ভেতর যাব না। যা এ যুগের সবাইয়ের জানা প্রয়োজন, সেগুলোই বলচি। বলতে গেলে, দৈনিক বা সাপ্তাহিকের পৃথিবীব্যাপী ব্যবসায়িক হিড়িকে এ শিল্পটি এখন চৌদুনে দাপাচ্চে। তাই এর রকমারিরও শেষ নেই। তবে এর অসুবিধা হল এই যে, এ লাইনের লোক দুনিয়াতে খুব বেশি মিলচে না। দ্বিতীয়ত, সংবাদপত্রের ব্যবসায়ের ফাঁপতির চোটে কাগজে সেরকম বড় স্থানও সঙ্কুলান হচ্চে না। হবেই বা কেন? অত বিজ্ঞাপনের বানের জল তুলতে পারলে কে-ই বা ছাড়ে? তাই নেই বড় মাপের জাত কার্টুন— যাকে বলি ‘এডিটরিয়াল কার্টুন’, অর্থাৎ যেটার মর্যাদা একটা উচ্চাঙ্গের সম্পাদকীয়ের পর্যায়ে পড়ে। আর, নেই এই উচ্চস্তরের কার্টুনের চাহিদা। কেননা বনস্পতির চেয়ে খাঁটি গব্য হজম করা কঠিন। এ হচ্চে ভারতের কথা।
এই কারণেই পকেট-কার্টুনের জন্ম। এটাতে সংবাদপত্রের ব্যবসায়ীদের সাড়ে-বত্রিশ ভাজার মালই পাওয়া যাবে। অল্প স্থানেও হয়। আবার এটাতে ছবির নিচে হাল্কা কথা লিখে সেটাকে খাড়া করার সুবিধাও মিলবে। এর উপরে আরও মজা আছে। এখানে কোন বড় ফিলসফির বালাই নেই। সেই কারণে পকেট-কার্টুন উপরতলা থেকে বটতলা পর্যন্ত সবাইকেই খুশি করে।
কিন্তু তা হলেও মাঝে-মাঝে পকেট-কার্টুনে এডিটরিয়াল-কার্টুন পর্যায়ের ছবিও আঁকা হয়ে যায়। সেটা শিল্পীর প্রতিভার উপর নির্ভর করে। এখানে একটু উত্তমপুরুষের কথা বলতে হচ্চে, সে জন্য ক্ষমা চাই। বলতে গেলে, লেখক নিজেই এ জিনিসটা উত্তর-পূর্ব ভারতে প্রচলিত করিয়েছেন তাঁর এক সহকর্মী বন্ধুর মাধ্যমে। এবং দেখেওছি যে ভারতের শ্রেষ্ঠ পকেট-কার্টুন এই কলকাতাতেই।
এই যে পকেট-কার্টুনে এডিটোরিয়ালের মর্যাদার জিনিস প্রকাশ পেয়ে যাচ্চে মাঝে-মাঝে, এতে সংবাদপত্র ব্যবসায়ে শ্যাম-কুল দুই-ই বজায় থাকচে। অর্থাৎ উঁচু পর্যায়ের ছবিও হল, অনেকখানি স্থান বেঁচে যাওয়াতে সেখানে আরও একটা বিজ্ঞাপনও দেওয়া গেল। তা না-হলে অত চমৎকার Statesman-এর Moonim-এর ছবিকে এখন মাইক্রোস্কোপ দিয়ে দেখতে হয়? উপভোগ তো দূরের কথা!
ভারতের একটা দুর্ভাগ্য, এখানে ছাপানোর প্রেস-প্রিন্টের অসুবিধায় পৃষ্ঠা বেঁধে দেওয়াতে ফল হয়েছে ফটো ও সংবাদের রকমারি ছাড়া পাঠকের আনন্দবর্ধনের জন্য কার্টুন পর্যায়ের আঁকা সরস ছবি প্রায় নেই বললেই চলে। নেহাত সেটা দুই ধরনের ছবি আমাদের নিজেদের সৃষ্টিতে চলছে; অর্থাৎ পকেট ও এডিটরিয়াল। সামাজিক হাসি ও সমস্যার ছবি এখন ফটোর বদলে কিছু-কিছু তৈরির চেষ্টা হচ্ছে এবং চলচেও। তা ছাড়া দু’চারটে স্ট্রিপ কার্টুন অর্থাৎ খুড়ো রেখাঙ্কিত জাতের মাল, এ-ও আছে। কিন্তু সারা দেশময় যে বিরাট চাহিদা, তাকে পূরণ করবে কে? সেই জন্যে বাইরের থেকে, বিশেষ করে আমেরিকা ও ইউরোপ থেকে ঝুড়ি ঝুড়ি বিলিতি মাল আমাদের কাগজের ঘাড়ে চেপে বসেচে। শুধু চেপে বসেই ক্ষান্ত হয়নি, একেবারে কোট-পেন্টুলুনের সমাজ আমাদের ‘ভারতে’ গামছা-পরা সমাজকে একটা ওয়েলেসলি পাড়ায় খাড়া করার চেষ্টা করচে। অথচ আমাদের দেশের ছেলেরা কি এ মাল তৈরি করতে পারে না? নিশ্চয়ই পারে, এবং পাশ্চাত্যের যে-কোন দেশের পাশে দাঁড়াতে পারে।
তবে মূল দরকারই হল অর্থ। কে-ই বা আমাদের ছেলেদের স্কুলে খাঁটি ছবি আঁকা শেখাবে? না, মডার্ন আর্ট নয়! মূল প্রয়োজন হল ড্রাফটসম্যানশিপ বা ইলাস্ট্রেশন। অর্থাৎ যে-ছবি দেখলে কুকুরকে কুকুরই মনে হবে, শেয়াল বলে ভুল হবে না। ওদের দেশে এটা যারা ভালো জানে, তারা বেশ ভালো পয়সাই উপার্জন করে। তার উপরে যদি তাদের মাথায় ভালো কার্টুন এবং দার্শনিক ও জ্ঞানগর্ভ আইডিয়া থাকে, তবে তো সোনায় সোহাগা!
কিন্তু ছবি আঁকাটাই মূল। কেননা ওদেশের আইডিয়ায় লোকেরা ছবি আঁকার লোককে দিয়ে তাদের নিজেদের গল্প আঁকিয়ে নিয়ে পৃথিবীতে সেই সব গল্পকে চালু করে। সে তো আর আমাদের দেশের এক টাকার ছবি নয়। অথচ এর চাইতে বেশি দাম আমেরিকা দেয়ও না। তাই একটা কার্টুনকেই ওরা ২০-৩০ এমনকী ১০০-রও বেশি কাগজ ছাপিয়ে একটার জন্যই ১০০ টাকা উপার্জন করে।
সোজা ব্যবসা। আমরা বাঙালিরা এ কাজে অগ্রসর হতে পারছি না। কারণ আমাদের প্রতিভা আছে, ব্যবসার জ্ঞান একেবারেই নেই। অবাঙালিরা এটাতে এখনও হাত দেয়নি। এই কারণে ওদেশে আমাকে ১৯৬০ সালে থাকতে বলেছিল। আর কানে-কানে ফিসফিস করে বলেছিল— থেকে যাও ভাই, you will be millionaire! কিন্তু কেমন যেন একটা দেশছাড়া জীবন, এই ভেবে ওদের কথা শুনিনি।
কার্টুন ছবির রকমারির কোন শেষ নেই। থালা-ঘটি-জুতো বা জামা-শাড়ি, এরা যেন নিজেদের সুখ-দুঃখের কথা বলছে। এ ধরনের কার্টুনকে আমরা চলতি কথায় বলি ‘ফ্যান্টাসিয়া’। তবে এগুলোকে ছবি এঁকে তাদের প্রাণবন্ত করে দেখানোর উপর নির্ভর করে। ওয়াল্ট ডিসনে তাঁর ফিল্ম কার্টুনে এ জিনিস অনেক করেছেন। লেখক নিজে একটা গ্রাম ও তার গাছপালা-পাহাড়ের দুঃখের ছবি পর্যন্ত করেছেন। আমারই ছেলেবেলায় একটা হাসিখুশি জাতের বইয়ে এরকম ছবি দেখেছি. ছবিগুলো তেমন কিন্তু ভালো হয়নি, তবে ছড়াটা মনে আছে— খোকার স্বপ্ন।
‘দোয়াত আর কলমে যেন চলছে হাতাহাতি।
পেন্সিলটা তেড়ে এসে স্লেটে মারে লাথি।
বেতের চেয়ার লাফিয়ে ওঠে টেবিলখানার ঘাড়ে।
লেখার খাতা প্রথম ভাগের ঝুঁটি ধরে নাড়ে।
পড়ার ঘরে লেগে গেছে রুশ-জাপানির রণ,
আর কি খোকা থাকতে পারে ঘুমিয়ে অচেতন?
জেগে উঠে বসল খোকা স্বপ্ন মনে আসে।
যতই ভাবে ততই শুধু খিলখিলিয়ে হাসে।
এই সব কারণেই একটা জিনিস আজকাল দেখতে পাচ্ছি, ছবি ও তার আইডিয়ার জোর নেই বলেই ছড়া ও টিপ্পনি দিয়ে কার্টুন দাঁড় করাতে হয়।
এ ছাড়া Pantomime (প্যান্টোমাইম) জাতের ছবি, অর্থাৎ যে-ছবিতে কোন লেখাই থাকে না, যাকে শুধু ছবি দেখেই বুঝতে হয়। ওসব ছবির খুব মর্যাদা থাকলেও বাজারে তার ডাক কম। কেননা লোকের যদি অত কষ্ট করেই ছবি বুঝতে হয়, হাসতে হয়, তবে তাকে কে কিনে ছাপাবে? তাই দুনিয়ার সব কার্টুনকেই আজকাল লেখা দিয়ে দাঁড় করানো হয়, তা সে আমেরিকারই হোক বা ইউরোপেরই হোক। শস্তা মাল, পৃথিবীতে যত ছড়ায় তত ব্যবসার লাভ। বটতলার লোকও হাসবে, দোতলা-তেতলার সমাজও উপভোগ করবে, মন্দ কী! আমি যুক্তরাষ্ট্রের সব বড়-বড় সিন্ডিকেটে গিয়ে দেখেচি । সেখানকার কর্তারা আমাকে বললেন— তোমার ওই খুড়োর Pantomime মাল আমাদের (King Feature Syndicate) বড়জোর গোটা আট-দশ বাজারে চলচে, বাকি সব প্রায় ৮০-৯০টাই ছবিতে লেখা মাল পৃথিবীতে ছড়িয়ে আছে। এই লেখা মালই হল মিষ্টান্ন মিতরে জনাঃ।
এতে অনেক কথা এসে পড়ে। Pantomime হল বিগত যুগের। অর্থাৎ ইউরোপের যুগের। এই কারণে ইউরোপের কার্টুনিস্টরা আমেরিকানদের অপাঙক্তেয় মনে করে। তারা সোজাই বলে দেয়— তোমাদের ওগুলো আবার কার্টুন! (তা স্ট্রিপ বা পলিটিক্যাল বা উইট-হিউমার, যা-ই হোক না কেন)। দেখলে মনে হয় ছবির মধ্যে লেখাগুলো যেন ছবির আকাশে কতকগুলো মেঘ হয়ে পঞ্জিকার পাতার মত স্থান দখল করে রয়েছে। এবং সবচেয়ে আশ্চর্য, ইউরোপীয়রাও এই আমেরিকান পদ্ধতি নকল করে চলচে, কারণ ব্যবসা করে স্থান দখল করার প্রশ্ন সর্বাগ্রে।
আমার এক মার্কিন বন্ধু Reid fellowship নিয়ে সারা ইউরোপ ঘুরে ১৯৫৯ সালে বিশ্বের কার্টুনিস্টদের একটা ফিরিস্তি নিয়েছিল। আমাকে সেটা দিয়েচে। প্রয়োজনীয়টুকু নিচে তুলে দিলাম। প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান তাকে লিখে জানিয়েছিলেন— Sometimes there is more history in a single political cartoon than can be found in a whole month of newspapers. – 17 April 1958.
এখন ফিরিস্তিগুলো নিচে দিলাম। এগুলো ১৯৫৮ সালের হিসাব। এখন এ-ও বদলিয়ে গেছে।
‘পৃথিবীতে Vicky-কেই এখন সর্বশ্রেষ্ঠ কার্টুনিস্ট বলে লোকে মনে করে। আমি আশ্চর্য হলাম জেনে যে আমাদের Herblock-কে এক বৃটেন ছাড়া অন্য দেশে প্রায় কেউই জানে না।’
‘David Lowe-কে সবাই মনে করে Over the hill অর্থাৎ নামতির মুখে। তবে Sennep-এর আইডিয়ার জন্যে সে খুব সম্মানিত বৃটেনে। বৃটেনই বলতে গেলে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ স্কুল এখন।’
‘আমেরিকানরা এখন সেই জাতের কার্টুন আঁকচে যে-মাল আমরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর তৈরি করতুম। তোমাদের ছবিগুলোতে যেন কোন প্রাণের স্পন্দন নেই (Uninspired)।’ এটা হচ্চে Vicky-র কথা। ‘তোমাদের সামাজিক কার্টুন এত ভালো, কিন্তু পলিটিক্যালগুলো যাচ্ছেতাই।’— এটাও ভিকির কথা। ‘তোমাদের কার্টুনগুলো Allegorical, আমাদেরগুলো satirical.’— একজন ফরাসির (Lap) মত। ‘তোমাদের ওগুলোকে বড্ড লেখা দিয়ে, Symbol দিয়ে খাড়া করো’— এটা একজন ফিনল্যান্ডের শিল্পীর কথা (Kari)। ‘ছবিতে অত লেবেল চাপাও কেন?— ফরাসিরা এ সব ছবিকে অপমান করা হচ্ছে মনে করে।’— একজন ফরাসির কথা। ‘জন বুল চলে গেছে, Uncle Sam-ও চলে গেছে— ওদের ছবির কার্টুন এখন অচল।’— ডেভিড লো-র কথা।
কার্টুন আঁকার স্টাইল যুগের সঙ্গে বদলায়, যেমন বদলায় পোশাকের স্টাইল। কিন্তু ক’টা মানুষ যুগের সঙ্গে বদলাতে পারে? সকলে তো আর রবিঠাকুর নয় যে শেষবয়সে গদ্যকবিতা ও ছবি আঁকা শুরু করলেন? যে নতুনকে আহ্বান করে, সে-ই বেঁচে যায়। কিন্তু সেটা ছ্যাবলামির বা গর্হিত রুচির, নতুনত্ব নয়। তাতে শিল্পীর সম্মান থাকে না। লন্ডনের ইলিংওয়ার্থ তো আফিসেই যায় না। সে সোজা লোক মারফত ছবি পাঠিয়ে দিয়ে খালাস। নইলে সে বলে শিল্পীর সম্মান থাকে না।
পয়সার ব্যাপারে বৃটেনের কার্টুনিস্টরা বেশ ভালো রোজগার করে। অনেকে তো রোলস রয়েসও চড়ে, কিন্তু বৃটেনের বাইরে অন্য অবস্থা। নেহাত খুব মাথাওলা কয়েকজন ছাড়া বৃটেনের বাইরের শিল্পীরা অনেকগুলি কাগজে কার্টুন ও ছবি বা ডিজাইন এঁকে এবং সঙ্গে একটা কাগজে পুরো সময় কাজ করে, তবে কোনক্রমে বেঁচে থাকে।
জার্মানিতে কার্টুনিস্টের সংখ্যা সবচাইতে বেশি— ৭৫। সে হিসাবে ফ্রান্সে ২৬, হল্যান্ডে ৫, ইতালিতে ১৮, বৃটেনে ১৩। ওদের দেশে এসোসিয়েশনের বাইরের কারও মাল বিক্রির সাধ্যিই নেই। তাই ঐদেশের শিল্পীরা পয়সা পায়।
সূত্র : রঙ্গ ব্যঙ্গ রসিকেষু, শতবর্ষে কাফী খাঁ সংখ্যা, ৭ম বর্ষ, ১৪০৭ বঙ্গাব্দ।