চিত্তপ্রসাদ, চিত্তপ্রসাদ ভট্টাচার্য, চিত্রশিল্পী, কার্টুনচিত্রী। চিত্তপ্রসাদের জন্ম ২১ জুন, ১৯১৫।
‘কার্টুনপত্তর’ চিত্তপ্রসাদকে মনে করবে, মনে করাবে ধারাবাহিক।
এই লেখাটির নাম ‘চিত্তপ্রসাদ’। লেখক অশোক ভট্টাচার্য। লেখাটি ছাপা হয়েছে ‘কালচেতনার শিল্পী’ বইয়ে, তার কিছু অংশ ‘কার্টুনপত্তর’-এ।
…
১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শুরু। জার্মানি আর ইটালির সঙ্গে যোগ দিয়ে জাপান কিছুদিনের মধ্যেই দ্রুত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ঔপনিবেশিক দেশগুলো অধিকার করে নেয়। ইংরেজ শাসনাধীন বার্মা দখল করার পর ভারত আক্রমণের প্রস্তুতি হিসেবে জাপান চট্টগ্রামে বিমান আক্রমণ শুরু করে। অপ্রস্তুত ব্রিটিশ সরকার চট্টগ্রাম-সহ পূর্ব বাংলার বিস্তৃত অঞ্চল থেকে খাদ্যশস্য সরিয়ে নিল, উদ্দেশ্য জাপান এসে যেন রসদ না পায়। দেশের মানুষের প্রতি এই উদাসীনতার ফল হল ভয়াবহ। দেখা দিল দুর্ভিক্ষ। যেটুকু চাল ছিল তাও চলে গেল দেশি মজুতদারদের গুদামে— বিক্রি হতে থাকল চড়া দামে, গরিব মানুষের নাগালের বাইরে। গ্রামে গ্রামে অনাহার। চিত্তপ্রসাদ তখন চট্টগ্রামে কলেজ-ছাত্র। সংবেদনশীল চিত্তপ্রসাদ মানুষের পাশে দাঁড়াতে ব্রতী হলেন। যুদ্ধ আর দুর্ভিক্ষের কঠিন দিনগুলিতে চিত্তপ্রসাদের সঙ্গে কম্যুনিস্ট পার্টির যোগাযোগ। চিত্তপ্রসাদ পার্টি সদস্য ১৯৪১-এ। পার্টি-কমরেড হয়ে ঘুরতে থাকেন গ্রামে-গঞ্জে। আঁকলেন অনাহারে থাকা মানুষের ছবি। এবং পার্টির ফ্যাসিবাদ বিরোধিতার পোস্টার।
চট্টগ্রাম থেকে চিত্তপ্রসাদকে কলকাতায় নিয়ে আসেন কম্যুনিস্ট ছাত্র-নেতারা। থাকতেন ছাত্র ফেডারেশনের আস্তানায়। তাঁর আঁকা ছাপা হতে থাকল পার্টির বাংলা কাগজ ‘জনযুদ্ধ’-এ, ইংরাজি কাগজ ‘পিপলস’ ওয়ার’-এ। তিনি তখন এঁকেছেন ছবি, পোস্টার, কার্টুন। সেই সময়ে তাঁর লেখা প্রবন্ধ ‘আধুনিক ভারতীয় শিল্পকলার ভূমিকা’য় চিত্তপ্রসাদের ঘোষণা , ‘এ যুগের জনতার জীবনের সব দিকে সকল ক্ষেত্রেই বণিক-রচিত যত সংকট, তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের তেজ জাগাতেই প্রয়োজন মনুষ্য-দৃপ্ত শিল্পকলার।’ চিত্তপ্রসাদ সে সময় তাঁর সমাজমুখী দৃষ্টিভঙ্গির সমর্থন পেয়েছিলেন কলকাতার ফ্যাসিবাদবিরোধী লেখক ও শিল্পী সংঘের শিল্পী-সাহিত্যিকদের কাছে। চিত্তপ্রসাদ ১৯৪৩-এ বন্যা আর দুর্ভিক্ষপীড়িত মেদিনীপুর জেলা ঘুরে রিপোর্ট লেখার নির্দেশ পেলেন পার্টির কাছ থেকে। এই কাজের ফসল তাঁর আঁকা ছবি-সহ ডায়েরি ‘হাংরি বেঙ্গল’। প্রকাশিত হওয়ার পরই ব্রিটিশ সরকার সব বই পুড়িয়ে ফেলেছিল। বইটির যে কয়েকটি কপি বাঁচিয়ে রাখা গিয়েছিল, তা পরে প্রকাশিত হয়েছে।
কম্যুনিস্ট পার্টির কাজে আরও বড় ভূমিকা নেওয়ার জন্য ১৯৪৬-এ চিত্তপ্রসাদকে বোম্বাইতে পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে নিয়ে যান তখনকার পার্টি সেক্রেটারি পি সি যোশি। তখন থেকে বাকি কয়েক দশক চিত্তপ্রসাদ ছিলেন বোম্বাইয়ের অধিবাসী। শহরতলী আন্ধেরির শ্রমিক পাড়ার পুরনো একটা বাড়ির একতলার বাসিন্দা।
চিত্তপ্রসাদ বোম্বাইতে শ্রমিক মিছিলের সহযাত্রী। নৌ-বিদ্রোহের সমর্থনে ধর্মঘটি শ্রমিক আন্দোলনের অংশীদার। তাঁর আঁকায় এমন সব বিষয়।
১৯৪৮ সালে কম্যুনিস্ট পার্টির কলকাতা কংগ্রেসে নেতৃত্ব ও রাজনৈতিক কর্মসূচির আমূল পরিবর্তন। শেষ হল পি সি যোশির সম্পাদক-কাল। পি সি যোশি ছিলেন কলাশিল্পের প্রগতিশীল বিকাশের প্রতি বিশেষ আগ্রহী। শিল্পীরা তাঁর সমর্থনে কলকাতা আর বোম্বাইকে কেন্দ্র করে এক সৃজনশীল কম্যুনিস্ট শিল্পধারা সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়েছিলেন। নতুন নেতৃত্বের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল আলাদা। তারা শিল্পগুণের চেয়ে বেশি আগ্রহী ছিলেন শিল্প-সাহিত্যের প্রচারধর্মিতায়। চিত্তপ্রসাদের শিল্পীসত্তা পরিবর্তিত পরিবেশকে মেনে নিতে পারল না। নতুন রাজনৈতিক প্রস্তাবকেও তিনি সংকীর্ণতাবাদী বলে মনে করলেন। সর্বক্ষণের পার্টি-কর্মী চিত্তপ্রসাদ পার্টির সঙ্গে সম্পর্ক শেষ করলেন ১৯৪৯-এ। সাংগঠনিক সম্পর্ক ছাড়লেও বৃহত্তর মতাদর্শের ক্ষেত্রে তিনি রয়ে গেলেন নিষ্ঠাবান মার্ক্সবাদী।
চিত্তপ্রসাদ ছিলেন প্রকৃত মার্ক্সবাদী শিল্পী। নিজের বুদ্ধিবৃত্তিকে অপরের আজ্ঞাবহ করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি। কম্যুনিস্ট দায়বদ্ধতা থেকে মুক্ত হতে পারেননি। এটা এক দিক। অন্য দিকে জীবনধারণের প্রশ্ন। বোম্বাইয়ের বাজারে তাঁর ছবি বিকোবে না। কমার্শিয়াল শিল্পীদের মর্যাদাহীন কর্মজীবনের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ছিল। প্রবল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন আদর্শবাদী শিল্পী হিসাবে চিত্তপ্রসাদের পক্ষে সে পেশাকে গ্রহন করা ছিল অসম্ভব।
চিত্তপ্রসাদের আঁকার একটি মাধ্যম লিনোকাট। তাঁর নিজের কথায়, ‘লিনোকাট দিয়ে কম খরচে, কম সময়ে, সারা দেশময়, সারা পৃথিবীময়… ছড়িয়ে দেওয়া যায়।’ ড্রইং, উডকাট, প্যাস্টেল, জলরঙ, তেলরঙ, সব মাধ্যমে ছবি আঁকার অভ্যেস থাকলেও ‘কম খরচে’ সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়ার সম্ভাবনার কথা ভেবেই লিনোকাটকে তিনি প্রকাশের প্রধান মাধ্যম করে নেন।
চিত্তপ্রসাদের প্রথম পরিচয় দুর্ভিক্ষের চিত্রকর। বাংলার মন্বন্তরের অভিজ্ঞতার সঙ্গে মার্ক্সবাদের শিক্ষা যখন থেকে সংশ্লেষিত হয়, তখন থেকেই তিনি নিপীড়িত শোষিত মানুষের একনিষ্ঠ চিত্রকর। সে ছবি কেবলই দুঃখ-বেদনা- হতাশা-অসহায়তার ছবি নয়। দেশে কিংবা বিদেশে, নিপীড়িত মানুষ শোষণ আর অপশাসনের বিরুদ্ধে যখন যেখানে সংগ্রাম করেছেন, তার ছবিও এঁকেছেন তিনি সমান আবেগে। ফ্যাসিবাদী শক্তির বিরুদ্ধে আঁকা কার্টুন তাঁর বিশ্বচেতনার পরিচয় বহন করে।
বোম্বাইতে চিত্তপ্রসাদ আর পাঁচজন আত্মপ্রতিষ্ঠাকাঙ্ক্ষী, উচ্চাভিলাষী শিল্পীর মত কাটাননি। সব সময়ে থেকেছেন তাদেরই মধ্যে যারা শ্রমজীবী এবং বঞ্চিত। বাংলার মন্বন্তরে ১৯৪৩-এ যেমন তিনি ক্ষুধিত চাষিদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন, তেমনই দশ বছর পর ১৯৫৩-এ তিনি দাঁড়ান মহারাষ্ট্রে দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের মাঝখানে গিয়ে। স্কেচ এঁকেছিলেন সত্তরটি, আর ফটো তুলেছিলেন ছ’শ পঞ্চাশটি। শত চেষ্টাতেও সেগুলি নিয়ে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করতে পারেননি তিনি। আসলে তখন কম্যুনিস্ট পার্টিতে আগেকার মত সংস্কৃতি সম্পর্কিত বিশেষ সচেতনা ছিল না। আর সে কারণেই পার্টির প্রতি পুরনো আস্থা হারিয়ে ফেলেছিলেন চিত্তপ্রসাদ। যেখানে তিনি লিনোকাটের উপযোগিতার কথা উল্লেখ করেছিলেন, সেখানে তিনি তাঁর ক্ষোভ আর হতাশার কথাও ব্যক্ত করেছেন। ‘লিনোকাটেও সহায়তা দরকার— mass organisation-এর, progressive ছাপাখানার,… পার্টিতে art consciousness না থাকলে,… বিফল হবে আমার সব শ্রম।’
চিত্তপ্রসাদ সেই স্বল্প সংখ্যক শিল্পীদের অন্যতম, যারা স্বাধীনতা-উত্তর বাণিজ্যিক পরিবেশে নিজের শিল্পকর্মকে বাজারি পণ্য করে অর্থোপার্জনে মনোযোগী না হয়ে বরং প্রথম জীবনের জীবনাদর্শে সাধারণ মানুষের স্বার্থে আপন প্রতিভা নিঃশেষ করেছেন। তিনি লিখেছিলেন, ‘এ যুগে আর্টিস্টের পক্ষে সমাজকে ভালবাসতে না পারাটাই আশ্চর্য ব্যাপার, এবং রোগের লক্ষণ।’
…
এই লেখাটিতে দুটি কার্টুন আছে। কার্টুন দুটি বিষয়ে কিছু বলা নেই। ‘কার্টুনপত্তর’ বলে নেবে।
কার্টুন আঁকার সময় ১৯৪৩। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ। জার্মানি, ইতালির মিত্র জাপান অক্টোপাসের মতন। এক-একটা শুঁড়ে দখল করা কোরিয়া, বার্মা, মালয়। একটা শুঁড় বাড়ানো ভারতের দিকে। যেখানে ভারতবাসী আটকে আছে ব্রিটিশ আমলাতন্ত্রের দমননীতিতে। আর একটি অংশ পাকিস্তান খসড়া প্রস্তাবে, জাপানের আক্রমণের দিকে পিছন ফিরে। জাপান শুধু বাধা পাচ্ছে চিন থেকে।
এই কার্টুনটির বিষয় কৃষক বিদ্রোহ। চিত্তপ্রসাদ ১৯৪১-এ এই কার্টুনটি যখন আঁকছেন, তাঁর কাছে তখন কৃষক বিদ্রোহের, আদিবাসী কৃষক বিদ্রোহের ইতিহাস। চিত্তপ্রসাদের আঁকা কৃষকের খালি গা, গলায় দড়ির ফাঁস, হাতে শিকল। শোষণের পরিচিত চিহ্ন। শোষকদের এঁকেছেন— বিদেশি শাসক, দেশীয় রাজন্য, সরকারি সশস্ত্র বাহিনী, জমিদার। কৃষক আক্রান্ত। পরিচিত দৃশ্য রচনা। চিত্তপ্রসাদের আঁকায় কৃষক বিদ্রোহী। হাতের শিকল ভেঙে, কাস্তে পাশে রেখে, অস্ত্রের দিকে হাত বাড়িয়েছেন। চারপাশের পরিচিত এঁকে রাখা সীমারেখার বাইরে কৃষকের অস্ত্র। বিদ্রোহী কৃষকের শরীরের মাপ ছাড়িয়ে আঁকা। ছবিতে চিত্তপ্রসাদের স্বাক্ষরও সীমারেখা ছাড়িয়ে।
শিল্পী প্রভাস সেনের লেখায় চিত্তপ্রসাদের পরিচিতি— ‘কম্যুনিস্ট পার্টির পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে তাঁর জোরালো হাতের শাদা-কালো ড্রইং, লিনোকাট, কার্টুন। অত্যাচারিত মানুষের প্রতি ড্রইং, লিনোকাটের লাইনে ভালবাসার অভিব্যক্তিতে তাঁর শিল্পকর্ম। ভুমিহীন চাষির জীবনের সংগ্রাম তাঁর শিল্পমাধ্যমে মমতায়, ক্রোধে প্রকাশ করেছেন।’