পরিতোষ সেন।।
আমাদের শিল্পশাস্ত্রে নবরসের কথা বলা হয়েছে। শৃঙ্গার, হাস্য, করুণ, রৌদ্র, বীর, ভয়ানক, বীভৎস, অদ্ভুত, শান্ত—এ সবই কোনো না কোনো ভাবে মানবজীবনের অনুভূতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে। চলতি কথায় আমরা বলে থাকি, হাসি এবং কান্না, এই দুই নিয়েই আমাদের অস্তিত্ব। কৌতুক কিংবা হাস্যরস– ইংরিজিতে যাকে হিউমার বলা হয়, তা ছাড়া আমাদের জীবন কী আন্দাজ নীরস হতে পারে, তা ভাবতেও আতঙ্ক হয়। কমিক অর্থাৎ ব্যঙ্গাত্মক দিক এই কৌতুকরসের একটি বিশেষ অঙ্গ। প্রাচীন চিত্রকলায় কিংবা ভাস্কর্যে যে-রসের পরিচয় পাই, তা সাধারণ ভাবে বলা যায় গম্ভীর প্রকৃতির। অর্থাৎ তাতে প্রধানত বীর, ভয়ানক, বীভৎস, অদ্ভুত ইত্যাদি রসের প্রাধান্যই প্রকট হয়ে উঠেছে। এ কথা আদিম এবং ধ্রুপদী শিল্প, এ দুয়ের বেলায়ই খাটে।
বিশেষজ্ঞদের মতে হাস্যরসের উৎপত্তি নাকি প্রথম দেখা যায় কথাসাহিত্যে। তারপর, তার আবির্ভাব হয়েছে চিত্রকলায় এবং অতি হালে টেলিভিশনেও। তবে এ কথা ঠিক যে, কৌতুক, ব্যঙ্গ, তথা বিদ্রূপাত্মক কিংবা শিল্পের উৎপত্তি মানুষকে কিংবা মানুষজনিত কোনো বিশেষ-বিশেষ অবস্থাকে ঘিরেই। আমাদের চারিত্রিক এবং ব্যবহারিক অনেক দিক আছে, যা হাসির খোরাক জোগায় এবং নির্মম হলেও ব্যক্তিগত বিদ্রূপ কিংবা কমিক আর্টে হাস্যরসের যেমন প্রাচুর্য থাকতে পারে, আবার বেদনা অর্থাৎ করুণ রসের প্রাধান্য থাকাও ততই স্বাভাবিক। আনন্দময় রসই হোক আর বেদনাসিক্ত রসই হোক, আমাদের মনকে নাড়া দিতে হলে এ দুই বিপরীত প্রকাশভঙ্গিতেই অতিরঞ্জন একটি অনিবার্য অঙ্গ। তবে এই অতিরঞ্জনে একটা সংযমের রাশ টানতেই হয়। তা না-হলে খেলো অর্থাৎ মোটা দাগের হয়ে যাবার একটা মস্ত আশঙ্কা থাকে। ব্যঙ্গ, বিদ্রূপ, হিউমার যত সূক্ষ্ম হবে ততই আমাদের বুদ্ধিকে সুড়সুড়ি দেবে এবং তা উঁচু দরের শিল্পের পর্যায়ে স্থান পাবে। যেমন ধরা যাক, চার্লস চ্যাপলিনের ছায়াছবি। হাস্য এবং কৌতুকের মাধ্যমে তাঁর কৃত ছবিগুলো আমাদের মর্মকে যে কী গভীর ভাবে স্পর্শ করে, সে কথা আর নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই। সে তুলনায় লরেল-হার্ডির ছবি স্থূল এবং সাময়িক আনন্দ দেয়। তাই মনে কোনো দাগ কাটে না। কিন্তু চ্যাপলিনের ছবি একবার দেখলে কি আর কখনো ভুলতে পারি? আপাত দৃষ্টিতে হাস্যরসে ভরপুর হলেও, তার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য এতই করুণরস-সিক্ত যে তা আমাদের খুব বেশি ভাবিয়ে তোলে। মার্ক টোয়েনের কথায় বলা যায়, ‘সরো ইজ প্রোফাউন্ডার দ্যান জয়, দেয়ার ইজ নো জয় ইন হেভেন।’ চ্যাপলিনের কথা এখানে পাড়ার উদ্দেশ্য এই যে, ব্যঙ্গ কিংবা হাস্যরসের এমন অদ্বিতীয় সম্রাট এ যুগে আর ক’জন জন্মেছে। তা ছাড়া যে-কথা আগে বলেছি যে, সিনেমাও তো কমিক আর্ট-ভুক্ত। মানবসমাজে যে-সব অসঙ্গতি কিংবা বেখাপ জিনিস আছে, তাকে বিদ্রূপের ধারালো তরবারির সাহায্যে সম্মুখ থেকে আক্রমণ করা যে-কোনো দায়িত্বশীল শিল্পীরই কর্তব্য। এবং এ কাজ কার্টুন, অর্থাৎ ব্যঙ্গচিত্রের মাধ্যমে যত অনায়াসে এবং যত জনপ্রিয় ভাবে করা যায়, অন্য আর কোনো মাধ্যমে হয়তো ততটা সম্ভবপর নয়।
সংবাদপত্র আমাদের অনিবার্য নিত্যসঙ্গী। এ ছাড়াও আছে সাপ্তাহিক, পাক্ষিক, মাসিক, ত্রৈমাসিক ইত্যাদি। এ সব মাধ্যমে ব্যঙ্গচিত্র, আমাদের সমাজের নানা নিন্দনীয় দিক, যেমন, কোনো ব্যক্তি কিংবা গোষ্ঠীবিশেষ দ্বারা কোনো সামাজিক অন্যায়কে জিইয়ে রাখার (বিবাহের পণপ্রথা, জাত-পাত, এবং শ্রেণীবিভাগ, ধর্মীয় কুসংস্কার, বউ-ঠেঙানো, সতীদাহের পুনঃপ্রচলন এবং আরও কত কী) বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করার যে একটা মস্ত বড় হাতিয়ার, সে বিষয়ে আর সন্দেহ কী। সামাজিক সমালোচনামূলক ব্যঙ্গচিত্রের আমদানি আমাদের দেশে সম্ভবত ইংল্যান্ড থেকেই করা হয়েছিল। কারণ ইয়োরোপীয় চিত্রকলায় উইলিয়াম হোগার্থ-ই (১৬৯৭-১৭৬৪) তাঁর চিত্রে ইংরেজদের বোকাটে দৈনন্দিন আচারব্যবহার নিয়ে প্রথম ব্যঙ্গ করার প্রবণতা দেখান; যদিও ইংরেজদের যে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলোকে তিনি বিদ্রূপ করেছেন, তা যে-কোনো দেশের মানুষের বেলায়ই খাটে। আসলে তিনি তো মানুষের দোষত্রুটি, দুর্বলতা, নির্বুদ্ধিতা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন। আরেক ইংরেজ, টমাস রোল্যান্ডসন (১৭৫৬-১৮২৭) মানুষের নাক-চোখ-মুখ এবং হাত-পা বিশেষ ভাবে অতিরঞ্জিত করে দেখিয়ে তাদের উপহাস্যাস্পদ করে তুলেছেন। এই অতিরঞ্জিত অবয়ব কিংবা গঠনযুক্ত কার্টুন খবরের কাগজের সম্পাদকীয়র সঙ্গে প্রথম দেখা দেয় উনিশ শতকের শেষের দিকে। এ সময়ে যে-সব শিল্পী তীব্র রাজনৈতিক কার্টুন আঁকায় প্রসিদ্ধিলাভ করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে ইংল্যান্ডের টমাস নেস্ট এবং ফ্রান্সের দোমিয়ে বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। দোমিয়ে-র নামটি মনে রাখার আরেকটি কারণ হল যে, যেমন রাজনৈতিক এবং সামাজিক ব্যঙ্গচিত্রের ক্ষেত্রে, তেমনই ইয়োরোপীয় চিত্রকলায় তাঁর অবদান অসামান্য। কোনো তুলনা না করে আমাদের দেশের এমন একজন শিল্পীর নাম করছি, যাঁর অবদানও এদিক থেকে কোনো অংশে কম নয়। চিত্রকর গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর আমাদের প্রাক্-স্বাধীনতা যুগের বুর্জোয়া সমাজের নানা নিন্দনীয় দিক নিয়ে যে-অসাধারণ ব্যঙ্গচিত্রমালা এঁকেছিলেন, তার জুড়ি এখনও মেলা দায়। কার্টুন যে কী বলিষ্ঠ ভাবপূর্ণ এক হাতিয়ার হতে পারে, তা তিনিই প্রথম আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন। প্রকাশভঙ্গি এবং চিত্রায়ণের দিক থেকে এ চিত্রমালা এমন জোরালো এবং আধুনিক মেজাজের যে, আজ পঞ্চাশ-ষাট বছর পরেও তার মান এতটুকুও হ্রাস পায়নি। দুর্ভাগ্যবশত আজকাল সামাজিক ব্যঙ্গচিত্র ক্বচিৎ কদাচিৎই চোখে পড়ে। তা ছাড়া, এসব গুরুগম্ভীর বিষয় ছাড়াও আমাদের জীবনের অসংখ্য দিক আছে যা নিয়ে নির্দোষ মন্তব্য করা যায় এবং যা আমাদের সাময়িক হাসির খোরাক হয়ে উঠতে পারে। এই তো কয়েক দিন আগে জনৈক ডাক্তারের চেম্বারে অপেক্ষাকালীন খেলাধুলোর কোনো ম্যাগাজিনের পাতায় দেখি একটি দৃশ্যের উপস্থাপনা করা হয়েছে, যেখানে একটি উইকেট ফল্ করার সঙ্গে-সঙ্গেই ‘ব্যাটম্যান’ তার পরিচিত সাজপোশাকে সে জায়গায় এসে হাজির। আম্পায়ার তাকে বলছেন, ‘দিস প্লেস ইজ ফর দ্য নেক্সট ব্যাটসম্যান!’ আরেকটি মেয়েদের ম্যাগাজিনের পাতায় তেমনই হাস্যকর একটি ব্যঙ্গচিত্র আমার নজরে এল, যার বিষয়বস্তু হল এক মধ্যবয়সী মহিলা এবং কথা-কওয়া পাখির বাজার। সেখানে কাকাতুয়া, ময়না, টিয়েপাখি ইত্যাদি দাঁড়ের ওপর পায়ে শেকল বাঁধা অবস্থায় রাখা আছে। একটি কাকাতুয়া মহিলার কানের কাছে ঝুঁকে বলছে, ‘Buy me. I know lots of dirty stories.’ কিংবা ধরা যাক আরেকটির কথা, যেখানে এক কচ্ছপ আরেক কচ্ছপকে বলছে ‘Well, if we got nothing else, we got great mileage.’ এমন কত নির্দোষ ব্যঙ্গচিত্রের উল্লেখই তো করা যেতে পারে। বলা বাহুল্য, পূর্বোক্ত সব ক’টি ব্যঙ্গচিত্রই বিদেশি এবং এ ধরনের হাল্কা মস্করা ওই সব দেশের যে-কোনো পত্র-পত্রিকাতেই পাওয়া যায়। এবং তার বৈচিত্র্য দেখে তাক লেগে যায়। এ কথা আমি কমিক-স্ট্রিপকে বাদ দিয়েই বলছি। কারণ, কমিকসে কাহিনীর মস্ত বড় ভূমিকা থাকে বলে তাকে বিশুদ্ধ কার্টুনের পর্যায়ে ফেলা যায় না।
আগেই বলেছি যে, আলো-ছায়ার মতোই হাসি এবং কান্না পরস্পরবিরোধী হলেও আমাদের জীবনের নিত্যসঙ্গী। কান্না ছাড়া আমাদের জীবনও যদি বা কখনো চলে, হাসি, অর্থাৎ হিউমার ছাড়া জীবন একেবারেই অকল্পনীয়। অপরকে নিয়ে হাসি-ঠাট্টা-মস্করা করায় আমরা খুব মজা পাই। কিন্তু নিজেকে নিয়ে মস্করা, ইংরিজিতে যাকে বলা হয় লাফিং অ্যাট ওয়ানসেলফ, ক’জন করতে পারেন? এ কথা যেমন আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে ঘটে, তেমনি ঘটে আমাদের জাতীয় জীবনের বেলায়ও। আমাদের তথা ভারতবাসীদের মধ্যে সব কিছুকে বড্ড সিরিয়াসলি দেখার একটা প্রবণতা আছে, যার দরুন হাল্কারসের ব্যঙ্গচিত্র প্রায় চোখে পড়ে না। তার মানে কি এই যে আমরা নিজেদের নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করতে ভুলে গেছি? আমাদের সেন্স অফ হিউমার কি তাহলে একেবারেই লোপ পেয়েছে? বিদেশে থাকাকালীন অনেক নাটক, Revue, সিনেমা এবং টেলিভিশন প্রোগ্রাম দেখেছি। বিশেষ করে ইংল্যান্ডে, যেখানে রাজা-রানি, উজির, ক্ষমতাসীন-আমলা, কেরানি, রাজনীতিবিদকে নির্মম বিদ্রূপের ছকে ফেলে হাস্যাস্পদ করে তোলা হয়েছে। এখানে বসেও এই হালে, বিবিসি এবং দূরদর্শনের কৃপায় আমরা এই ধরনের দুটি মজাদার সিরিয়াল– ‘ইয়েস মিনিস্টার’ এবং ‘ইয়েস প্রাইম মিনিস্টার’ দেখেছি। কয়েক বছর আগে দেখেছি আমেরিকার এক টেলিভিশন চ্যানেলে প্রেসিডেন্ট রেগনকে নিয়ে যাচ্ছেতাই রকমের মস্করা করতে। সেখানে এমন দুয়েকটি ফিল্মও দেখেছি যাতে করে সে দেশের প্রশাসন, সমাজব্যবস্থার নানা অন্যায় দিককে একেবারে উলঙ্গ করে দেখানো হয়েছে। এবং সবটাই করা হয়েছে কমিক এন্টারটেনমেন্ট হিসাবে। আমাদের দেশের রেডিয়ো-টেলিভিশন কিংবা সিনেমায় এ ধরনের এন্টারটেনমেন্টের কথা কি ভাবা যায়? এমারজেন্সি সংক্রান্ত ছায়াছবি ‘কিসসা কুর্সি কা’র পরিচালক এবং নির্দেশককে কী আন্দাজ নাজেহাল হতে হয়েছিল সে কথা তো রীতিমত একটা ছোটখাটো ইতিহাস হয়ে আছে। সত্যিকারের ডেমোক্রেটিক ব্যবস্থায়, প্রয়োজন হলে, ছোট-বড় সবাইকেই, ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ-মস্করার কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে হাস্যাস্পদ করে তুলতে হয় বৈকী। এখানেই কার্টুন অর্থাৎ ব্যঙ্গচিত্রের সার্থকতা খুব বেশি। কারণ, এ মাধ্যমটি ব্যয়সাধ্য নয়, সময়সাধ্যও নয়। যদিও থিয়েটার, সিনেমা, টিভি মাধ্যম হিসেবে অনেক বেশি শক্তিশালী এবং মানুষের মনে সহজেই প্রচণ্ড আঘাত হানতে পারে।
পথপ্রদর্শক গগনেন্দ্রনাথের যুগের পর আমাদের দেশে, বিশেষ করে স্বাধীনতা-উত্তর কালে পত্রপত্রিকার সংখ্যা যেমন বেড়েছে এবং বাড়ছে, কার্টুনিস্টদের সংখ্যাও প্রায় সেই হারেই বাড়ছে। তবে এঁদের মধ্যে শতকরা নব্বই-পঁচানব্বই জনই পলিটিকাল কার্টুনিস্ট হিসেবে পরিচিত এবং শুধু এ-শ্রেণীর ব্যঙ্গচিত্রই এঁকে থাকেন। কিন্তু আমাদের দেশে সামাজিক সমস্যাগুলো এতই গুরুতর যে, সোশ্যাল কার্টুনিস্টদের প্রয়োজন বেশি ছাড়া কম নয়। তা ছাড়া সর্বোপরি চাই কার্টুনের ম্যাগাজিন, যাতে আমাদের সবরকম পরিস্থিতিকে নিয়ে আমরা হাসি-ঠাট্টা করতে পারি। যে-জাত নিজেদের নিয়ে মস্করা করতে পারে না, সে জাতকে অবিরাম সজীব রাখতে গেলে যেমন চাই খাওয়া-পরার ব্যবস্থা, তেমনই চাই ‘দি এবিলিটি টু লাফ অ্যাট ইটসেলফ’। এবং তার জন্য চাই প্রচণ্ড ‘উইট’, কারণ ‘উইট’ এবং ‘হিউমার’, এই দুইয়ের সংমিশ্রণেই সৃষ্টি হয় উঁচুদরের কার্টুন।
সূত্র : রং তুলির বাইরে, ভাষাবিন্যাস, কলকাতা, ২০০৮;
ছবির সূত্র : মিনি রেটরোস্পেকটিভ, বিড়লা আকাদেমি অফ আর্ট অ্যান্ড কালচার