এই পত্রিকা থেকে বিশ্বদেব গঙ্গোপাধ্যায়-এর লেখা
বাংলা শিশুসাহিত্য ও তার অলংকরণ, বলতে গেলে হাত ধরাধরি করে পথ চলা শুরু করেছে। ১৮১৬ সালে গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল’ প্রকাশ করেছিলেন, যেটি হল প্রথম সচিত্র বাংলা বই। এ বইতে ছবি ছিল মাত্র ছ’টি, এঁকেছিলেন রামচন্দ্র রায়। তার বহু আগেই ১৭৭৮ সালে হুগলীতে প্রথম ছাপা বাংলা বই বেরিয়ে গিয়েছিল, হ্যালহেড সাহেবের বাংলা ব্যাকরণের বই।
যা-ই হোক, বাংলা বইয়ে ছবি ছাপা শুরু হয়েছিল কাঠখোদাই ব্লকে আর ধাতুর পাতে খোদাই করা ব্লকে। সে সময়ে শিল্পীরা যে শুধু ছবি আঁকতে জানতেন তাই নয়, তাঁরা জানতেন কেমন করে কাঠের ব্লকে বা ধাতুর পাতে সে ছবি খোদাই করতে হয়। তাঁদের কাজের মান ক্রমশ উন্নত হয়েছিল, সেকালের বটতলার ছাপা বইয়ে তাঁদের কাজের নমুনা দেখলে অবাক হতে হয়৷
তবে একটা কথা, তখনকার বটতলার ছাপা ছবিগুলিকে বিলেতিয়ানার নকল চোখে পড়ত, ফলে সেগুলোকে বাংলা বইয়ের বিষয়বস্ত্তর সঙ্গে মানানসই বলা যেত না মোটেই৷ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সাবেকি আমলের প্রথম ভাগ ও দ্বিতীয় ভাগ বর্ণপরিচয়, কথামালা কিংবা আরও পরে প্যারীচরণ সরকারের ফার্স্ট বুকের ছবিগুলো যাদের চোখে পড়েছে, তারা সেকালে ছাপা ছবির সঙ্গে একালের ছবির তফাত ধরতে পারবে নিশ্চয়৷ ছোটদের বইয়ের ছবি আঁকতে গিয়ে যাঁরা বিশুদ্ধ বাঙালিয়ানাকে অনুসরণ করেন, তাঁরা হলেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী (১৮৬৩-১৯১৫), যোগীন্দ্রনাথ সরকার (১৮৭৬-১৯৩৭), দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার (১৮৭৭-১৯৫৭)৷ উপেন্দ্রকিশোর অজস্র ছবি এঁকেছেন তাঁর টুনটুনির বই, রামায়ণ ও মহাভারত বইয়ে। শুধু তাই নয়, ছবি ছাপার ‘হাফটোন’ পদ্ধতি তিনিই এখানে চালু করেন। ফলে ছবিতে গাঢ় কিংবা হাল্কা রঙের তফাত বুঝতে পারা যেতে লাগল৷ দক্ষিণারঞ্জণের বিখ্যাত ‘ঠাকুমার ঝুলি’ শতবর্ষ ছুঁয়েছে, সে বইতে তো বটেই, তাঁর অন্যান্য বইতে তিনি নিজের লেখা নিজের ছবি দিয়ে সাজিয়েছেন৷ এঁদের ঠিক পরেই এসে পড়লেন যতীন্দ্রকুমার সেন (১৮৮২-১৯৬৬) ও সুকুমার রায় (১৮৮৭-১৯২৩)৷ যতীন্দ্রকুমার গিরীন্দ্রশেখর বসুর ‘লালকালো’ বইটি ছাড়া ছোটদের জন্য সে ভাবে ছবি আঁকেননি বটে, কিন্তু ছবিতে বিশুদ্ধ স্বদেশিয়ানাকে ধরে রেখেছেন এবং সুকুমার রায় নিয়ে এলেন ‘আবোল তাবোল’ আর ‘হ-য-ব-র-ল’র বিচিত্র মজাদার জগৎ৷ যেমন লেখা তেমন ছবি, রাজযোটক যাকে বলে৷ তাঁর লেখা পড়ে আর ছবি দেখে খোকাখুকুরা আহ্লাদে আটখানা হয়েছিল, সে আহ্লাদের রেশ এখনও চলছে৷ যোগীন সরকার তাঁর ‘হাসিখুশী’ বা অন্যান্য বইতে নিজেও ছবি এঁকেছেন, আবার বিলেতি বইয়ের লাগসই ছবি বসিয়েও দিয়েছেন, তাতে ক্ষুদে পাঠকদের ভালো-লাগা আটকায়নি৷ বাস্তবিকপক্ষে, ৪০-এর দশকে অনেক বাংলা ছোটদের বই সাজানো থাকত বিলেত থেকে ধার করে আনা নানান ছবিতে৷ এর মধ্যে বেশির ভাগ ছবি মজার, কার্টুনও থাকত, কাঠের ব্লকে ছাপা৷
তখন থেকে ছোটদের বইয়ে ছবির জায়গা বাঁধা হয়ে গেলেও কার্টুন বা ব্যঙ্গচিত্র আঁকা হয়েছে তার অনেক পরে৷ তার আগে বলে নিই, কার্টুন জিনিসটা কী? কার্টুন হল একরকম ছবি, যা দেখে লোকে মজাও পেতে পারে, আবার মাথায় হাত দিয়ে ভাবতেও বসতে পারে৷ রামায়ণের কুম্ভকর্ণের ঘুম লাগানোর ছবি কিংবা মহাভারতের ভীম যেখানে বকরাক্ষসের খাবারদাবার খেয়ে নিচ্ছে দেখে রাগে দাঁত কিড়মিড় করছে, সেগুলো দেখলে ছোটরা মজা পাবেই, কিন্তু সেগুলো ‘কার্টুন’ নয়৷ কার্টুনে মজা থাকবে তো বটেই, সেই সঙ্গে কেন মজা পাচ্ছ সেটা বুঝতে পারা চাই৷ যেমন একটা কার্টুনে দেশের খাদ্যমন্ত্রী বিশাল মোটা চেহারা আর ভুঁড়ি নিয়ে মঞ্চে দাঁড়িয়ে আছেন আর একজন কাঠির মতো রোগা লোক মাইকে ঘোষণা করছে দেশের খাদ্যাভাব নিয়ে খাদ্যমন্ত্রী বক্তৃতা দেবেন৷ বোঝা গেল দেশের লোক খেতে পাচ্ছে না, অথচ খাদ্যমন্ত্রী দেশের খাদ্য প্রচুর খেয়ে বিরাট ভুঁড়ি বাগিয়েছেন৷ তাকে ঠাট্টাটা করা হল কার্টুনের মাধ্যমে৷
একটা সাধারণ ঘটনা নিয়ে যেমন কার্টুন হতে পারে, তেমন দেশবিদেশের হালচাল, নেতাদের কাণ্ডকারখানা নিয়ে প্রচুর কার্টুন আঁকা হয়৷ সেগুলো রাজনৈতিক কার্টুন, সে সব খবরের কাগজ আর নানা পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়৷ ছোটরা সে কার্টুন উপভোগ করতে পারে না৷ ছোটদের কার্টুন আঁকতে গেলে এমন বিষয় নিয়ে আঁকতে হবে, যেটা দেখে তারা বুঝতে পারবে, মজাও পাবে৷
কার্টুন না হলেও সুকুমার রায়ের ছবি যেন কার্টুনের দোসর৷ আবোলতাবোলের রামগরুড়ের ছানা, কুমড়োপটাশ, কাঠবুড়ো কিংবা হিজিবিজবিজের ছবি দেখে ছেলে-বুড়ো সবাই হাসবে৷ সুকুমার কার্টুন এঁকেছেন দু-একটা, তলায় মজাদার ছড়ার ছররা ছুটিয়ে৷
৪০-এর দশকে ছোটদের বাংলা বইয়ে দেখা যেত জলরঙে আঁকা জসন উডের ছবি… দুই শিম্পাজির মজার কাণ্ড, সে সব ছবির ধারা অনুসরণ করে শৈল চক্রবর্তী, নারায়ণ দেবনাথ, ধীরেন বলেরা ছবি এঁকেছেন৷
বাংলা তথা ভারতের কার্টুন আঁকার পথিকৃৎ ছিলেন গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর৷ তবে ছোটদের নয়, তিনি আঁকতেন বড়দের কার্টুন৷ সেকালের সামাজিক অসঙ্গতি, অবিচার, অবিবেচনা, এ সবের বিরুদ্ধে পরিহাসের ছলে কার্টুন এঁকে প্রতিবাদ জানিয়ে গেছেন৷ এর পর এলেন দুই প্রতিভাধর কার্টুনশিল্পী, পিসিয়েল এবং শৈল চক্রবর্তী৷ পিসিয়েল আসলে প্রফুল্লচন্দ্র লাহিড়ী, এনার আর-একটা ছদ্মনাম ছিল ‘কাফী খাঁ’। মস্ত বড় কার্টুনিস্ট, ইতিহাসের অধ্যাপনা ছেড়ে কার্টুন আঁকার তুলি ধরেছিলেন৷ শৈলবাবু বিজ্ঞানের ছাত্র, কিন্তু ছোটবেলা থেকে নিজে-নিজেই ছবি আঁকাটা রপ্ত করেছিলেন৷ তখন কলকাতার দুই নাম-করা দৈনিক যুগান্তর (বাংলা) আর ইংরেজি অমৃতবাজার-এ প্রায় রোজই পিসিয়েলের কার্টুন বেরোত৷ শৈলবাবু ছবি আঁকার শুরুতে কার্টুন এঁকেছিলেন কিছুদিন, তার পর শুরু করলেন বড়দের বইয়ের মলাট আর ভিতরের ছবি আঁকা৷ সময়ের বিবর্তনে তিনি এলেন ছোটদের ছবির জগতে, বিশেষ করে শিবরাম চক্রবর্তীর লেখার সঙ্গে শৈল চক্রবর্তীর ছবি না হলে জমতই না৷ এই সময় শৈলবাবু নিজের ছবি আঁকার আদলটাই বদলে ফেলেন, সব ছবিতেই মজার আমেজ৷ ‘অমৃতবাজার’, তখনকার নামী ইংরাজি দৈনিকে রবিবারের পাতায় তিনি শুরু করলেন ‘ডাকু’৷ সে একটা বছর বারো-তেরোর ছোকরা, চুলে ‘অ্যালবার্ট স্টাইল’, টুকটাক মজার কাণ্ডকারখানা ঘটাতে লাগল৷ তার আগেই কাফী খাঁ’র ‘শেয়াল পণ্ডিত’ আর তার ‘কুমীর স্যাঙাত’ আর-এক বাংলা দৈনিক ‘যুগান্তর’-এর পাতায় জাঁকিয়ে বসেছে৷ প্রথমে শুধু ছবিই থাকত, তারপর ছবির তলায় চমত্কার ছড়া ছেড়ে দিতেন হরেন ঘটক৷ এর ওপর যুগান্তরের রবিবারের পাতায় চলত কাফী খাঁ’র কার্টুন-ছবি দিয়ে সাজানো গল্পের সিরিজ৷ সে সব গল্প যেমন উদ্ভট, তেমন মজার। ট্রলিবাবু, সবজান্তা বাবা, ভীমের গল্প, দুই বোকার গল্প, কুম্ভকর্ণের কাণ্ড, আরও কত কী! বানিয়েছিলেন একটা অদ্ভুত কার্টুন দেখার বই, ‘কাফী স্কোপ’৷ ক্ষুদে-ক্ষুদে বইগুলোর মাপ ছিল মাত্র ৩ ইঞ্চি x ২ ইঞ্চি, তাস শাফল করার মতো তাড়াতাড়ি পাতাগুলো উল্টে গেলে ছবিগুলো নড়াচড়া করত, আসলে ছবিগুলোর নড়াচড়া পর-পর আঁকা ছিল, সেটাই চোখে ধাঁধাঁ লাগিয়ে জ্যান্ত হয়ে উঠত৷ পরে যখন পিসিয়েল আমেরিকায় যান, ওয়াল্ট ডিজনে সাহেব তো বইগুলো দেখে তাজ্জব৷ বড়দের জন্যও যে-সব কার্টুন তিনি করতেন, তার মধ্যেও মাঝে-মাঝে ছোটদের ভাবনা চলে আসত৷ ‘Revolt of the Animals’ নাম দিয়ে অমৃতবাজারে কার্টুন করলেন পিসিয়েল। চিড়িয়াখানার বাঘ, সিংহ, হাতি, ভাল্লুক, জিরাফেরা ফেস্টুন আর পোস্টার নিয়ে ধর্মঘটে নেমেছে, হাতি বলছে তাকে আধপেটা খাইয়ে রাখা হয়েছে, বাঘ-সিংহরা বলছে তাদের বাসি মাংস খেতে দিচ্ছে, জিরাফ বলছে তার গলেমেঁ খুশখুশ সুতরাং ‘থ্রোট লজেন্স’ চাই ইত্যাদি। তার কয়েকদিন আগেই চিড়িয়াখানায় ঢোকার টিকিটের দাম দু’আনা থেকে বাড়িয়ে তিন আনা করা হয়েছে অর্থাৎ পশুরা বলতে চাইছে, হে কর্তৃপক্ষ তোমাদের রোজগার তো বাড়ল, এবার আমাদের দিকে একটু নজর বাড়াও৷
শৈল চক্রবর্তী এখন পড়ে আছেন ছোটদের ছবি নিয়ে, লেখকদের হাসির গল্পের সাথে সাদা-কালো আর রঙিন, দু’রকম ছবিই এঁকে চলেছেন ছোটদের মনের মতো করে, সেই সঙ্গে ‘যুগান্তর’-এ ছোটদের জন্য কমিক্স আঁকছেন৷ ‘কার্টুন’ নামে একটা বইও তিনি লিখেছিলেন ছোটদের ‘কার্টুন’ সম্বন্ধে তথ্য আর খবরাখবর জানাতে৷ আঁকার পাশাপাশি তিনি ছোটদের জন্য কলমও ধরেছিলেন৷
ইতিমধ্যে ছোটদের জন্য ছবি আঁকতে শুরু করে দিয়েছিলেন ধীরেন বল (১৯১২-১৯৯২) ও রেবতীভূষণ ঘোষ৷ ধীরেন বল বড়দের জগতে প্রবেশ করেননি৷ ছোটদের জন্য লিখেছেন গল্প, ছড়া, কবিতা আর করেছেন অজস্র অলংকরণ, সাদা-কালো আর রঙিন, দু’রকমই৷ রেবতীভূষণ তুলির টানে কার্টুন আঁকতেন, বড়দের জন্য আঁকতে-আঁকতে মাঝে-মাঝে চলে যেতেন ছোটদের আসরে৷ ছড়া লিখতেন মজাদার, তুলি দিয়েই ছড়াটা লিখে সেই তুলির টানেই তার ছবি আঁকা হয়ে যেত৷ ছবি-ছড়ার সেই যুগলবন্দি বহু পত্রপত্রিকায় বেরিয়েছে৷ এর পাশাপাশি পশুপাখির মজাদার ছবি আঁকায় তার জুড়ি কেউ নেই৷
সুনির্মল বসু (১৯০২-১৯৫৭) আর অখিল নিয়োগী (১৯০২-১৯৯৩), দু’জনেই নাম-করা ছোটদের লেখক, সাহিত্যজগতে প্রবেশের আগে কিন্তু ছোটদের লেখার আলংকারিক শিল্পী ছিলেন৷ সুনির্মলের চেয়ে অখিল নিয়োগী (নকল নাম স্বপন বুড়ো) অনেক বেশি ছবি এঁকেছেন, মজার হলেও কার্টুন নয়৷ পরে দু’জনেই ছবি আঁকা থেকে সরে এসে লেখায় মন দিয়েছেন৷
যে-সময়টার কথা বলছি, তখন ছোটদের মনের মতো দুটো পত্রিকা বাজারে ভালো চলছে, শিশুসাথী আর শুকতারা। দ্বিতীয়টা এখনও চলছে৷ এই দুটো কাগজেই নাম-করা লেখকরা লিখতেন, ছবি আঁকতেন নাম-করা শিল্পীরা৷ ‘শিশুসাথী’তে কার্টুন স্ট্রিপ আঁকতেন কাফী খাঁ, পরে এসে গেলেন চণ্ডী লাহিড়ী৷ একটা কার্টুনে যখন ছবিটা শেষ হয় না, তখন দুটো বা তিনটে বা আরও বেশি ছবি এঁকে সেটাকে শেষ করতে হয়, সব ছবিগুলোই হবে একই সাইজের, একেই বলে কার্টুন স্ট্রিপ৷ চণ্ডী লাহিড়ী আজও কার্টুন আঁকতে সক্রিয়, শুধু কাগজে নয়, টিভির পর্দায়ও তাঁর কার্টুনের দেখা মেলে, একসময় টিভির পর্দায় ছোটদের শিখিয়েছেন কেমন করে মজার ছবি আঁকা যায়৷ ‘Nodle Doddle’, বাচ্চাদের কার্যকলাপ নিয়ে এই চমত্কার বইটিও তাঁর৷ একটা সময় আনন্দবাজারে ছোটদের ‘আনন্দমেলা’ পাতায় শেষ পাতের রসগোল্লা পড়ার মতো তাঁর একটা কার্টুন স্ট্রিপ থাকত৷ কিছুদিন এই ধরনের কাজ তিনি ‘দৈনিক বর্তমানে’র ছোটদের পাতাতেও করেছিলেন৷
‘শিশুসাথী’তে কার্টুন স্ট্রিপ থাকলেও ‘শুকতারা’য় তখন তা থাকত না, ‘লরেল হার্ডি’র বিদেশি কমিকস ছাপা হয়েছিল কিছুদিন, ঐ পর্যন্ত৷ ষাটের দশকের মাঝামাঝি দেখা গেল দুটো হাফপ্যান্ট পরা বছর দশ-বারোর ছোকরার ফচকেমি শুরু হয়ে গেছে ‘শুকতারা’র পাতায়৷ হাঁদা একটু চালিয়াত, মাথায় চুলে ‘অ্যালবার্ট’ আর তার বন্ধু ভোঁদা, মোটাসোটা মাথার চুলটা কতকটা যেন ‘টিনটিনের’ মতো৷ ছবিতে তাদের নিয়ে এলেন নারায়ণ দেবনাথ, যিনি শুকতারার পাতায় গল্পের ছবি আঁকতেন তার অনেক আগে থেকেই৷ তার কিছুদিন পরে তিনিই শুকতারার পাতায় নিয়ে এলেন বাঁটুল দি গ্রেট-কে৷ বাঁটুল ব্যায়ামবিদ তো বটেই, গায়ের জোরে তার সঙ্গে এঁটে ওঠা যায় না৷ হাফপ্যান্ট আর স্যান্ডো গেঞ্জিতে তাকে দেখা গেল, ছোটদের বেশ ভালো লাগল৷ তাদের সে ভালো-লাগার রেশ এখনও চলছে৷ চল্লিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে নারায়ণ দেবনাথ তাদের বয়স না বাড়িয়ে শুকতারার পাতায় বাঁচিয়ে রেখেছেন, এদের নিয়ে এখন অ্যানিমেটেড কার্টুনও তৈরি হয়েছে৷ শ্রীদেবনাথ ছোটদের জন্য পরে এনেছেন নন্টে ফন্টেকে, এরাও স্কুল-পড়ুয়া দুই ছোকরা। এরাও এখন ছোটদের কাগজে ‘কিশোর ভারতী’-তে ফষ্টিনষ্টি করে যাচ্ছে৷ এ প্রসঙ্গে বলে রাখি শিশুসাথী বা শুকতারার বেশ পরে ষাটের দশকে শিশুসাহিত্যিক দীনেশরঞ্জন চট্টোপাধ্যায় বার করেন ‘কিশোর ভারতী’ পত্রিকা৷ তাঁরই অনুরোধে শৈল চক্রবর্তী আবার নতুন করে কার্টুন স্ট্রিপ সাজাতে শুরু করেন এখানে৷ ‘ডাকু’ অনেকদিন আগেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, ডাকুর হুবহু আদলে তিনি নিয়ে এলেন ‘ছোটকু’কে৷ এ কাগজে কমিকসও করেছেন তিনি, যে-ধরনের কাজ করেছেন নারায়ণ দেবনাথ, সুফি ও চণ্ডী লাহিড়ীও৷
১৯১৩ সালে উপেন্দ্রকিশোর বের করেছিলেন ‘সন্দেশ’ পত্রিকা৷ কিছুকাল চলে বন্ধ হয়ে যাবার পর তাঁর ছেলে সুকুমারের ছেলে বিশ্ববিশ্রুত সত্যজিৎ রায় ১৯৬০ সালে আবার সন্দেশ পত্রিকা বের করেন৷ বলতে গেলে সন্দেশের পাতাতেই ছোটরা খুঁজে পেল তাদের প্রিয় লেখক সত্যজিত্কে, কারণ এখানেই যুগপৎ ফেলুদা আর প্রেফেসর শঙ্কুর আবির্ভাব৷ সে সময় সন্দেশের সব লেখাকেই ছবিতে সাজাতেন সম্পাদক সত্যজিৎ নিজেই, নানা ধরনের বিচিত্র সে সব ছবি৷ মাঝে-মধ্যে কার্টুন স্ট্রিপও এঁকে দিয়েছেন সন্দেশের পাতায়, তার বৈশিষ্ট্য হল সে সব স্ট্রিপে কোন সংলাপ থাকত না, ছবি দেখেই মানে বোঝা যেত৷ সন্দেশে কাজ করেছেন চণ্ডী লাহিড়ী, অমল চক্রবর্তী, সুফি (নরেন্দ্র রায়), এঁরাও৷
৮০-র দশকে ছোটদের জন্য বেশ চমত্কার একটি সাজানো-গোছানো পত্রিকা বের হয়েছিল, ‘কিশোরমন’৷ তাতে কার্টুনে চিত্রকাহিনী পরিবেশন করতেন চণ্ডী লাহিড়ী, নিতাই ঘোষ, আলি (কবি সাহা), উজ্জ্বল ধর৷ শেষ শিল্পীর কার্টুনকাহিনি ভজা-গজা, তাদের বৈজ্ঞানিক পিসেমশাই ও তার তৈরি করা রোবট, এ সব ছিল দারুণ মজার৷ কয়েক বছর চলে সেটি বন্ধ হয়ে যায়৷ তার আগে দৈনিকের পৃষ্ঠা ছেড়ে পূর্ণাঙ্গ রূপে বেরিয়েছে ‘আনন্দমেলা’, সেখানে অহীভূষণ মালিক (১৯২৪-১৯৮৬) ‘নোলেদা’, যার আচরণ অনেকটাই নারায়ণ গাঙ্গুলীর ‘পটলডাঙার টেনিদা’র মতো৷ অহীভূষণ ‘নোলেদা’কে এঁকেছিলেন রস-সাহিত্যিক সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের চেহারা নকল করে৷ সঞ্জীব ব্যাপারটা যথেষ্টই উপভোগ করেছিলেন, কারণ অহীবাবুর সঙ্গে তাঁর দাদা-ভাই সম্পর্ক পাতানো ছিল৷ মজার ছবি আঁকার অনন্যসাধারণ বৈশিষ্ট্য অর্জন করেছিলেন অহীভূষণ। সিগনেট প্রেসের লীলা মজুমদারের ‘পদীপিসীর বর্মিবাক্সে’র ১ম সংস্করণে তাঁর আঁকা মজার-মজার ছবিগুলো আজও আমাদের চোখে ভেসে ওঠে৷
দীনেশরঞ্জন প্রয়াত হবার পর তাঁর পুত্র প্রকাশক ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় কিশোর ভারতী আজও চলছে ও সে পত্রিকার পাতায় কয়েকজন নতুন শিল্পী, যেমন জুরান নাথ, দিলীপ দাস, এরা কার্টুন কাহিনি আঁকছেন৷
দিল্লিতে চিল্ড্রেন ট্রাস্টে যোগ দেবার কারণে প্রবাসী ছিলেন কার্টুনিস্ট রেবতীভূষণ৷ দীর্ঘ ২৫ বছর পর তিনি পৈত্রিক বাড়িতে ফিরে আসেন হাওড়ার বালিতে৷ কলকাতার পত্রপত্রিকার পাতায় অতঃপর তাঁর কিছু-কিছু কাজের দেখা মিলতে লাগল, বিশেষত ‘কিশোর ভারতী’ এবং ‘কিশোর জ্ঞান-বিজ্ঞান’ পত্রিকায় তিনি ছোটদের জন্য কার্টুন দিতে শুরু করলেন৷ শেষোক্ত কাগজটি বের করতেন শৈব্যা প্রকাশনীর কর্ণধার প্রয়াত রবীন বল, যেটি ছিল মূলত বিজ্ঞান বিষয়ক পত্রিকা। তাই রেবতীভূষণ এখানে যে-সব কার্টুন এঁকেছেন, সেগুলোর সঙ্গে বিজ্ঞানকেও জড়িয়ে নিয়েছেন৷ ঠিক এই ধরনের কার্টুন এঁকেছেন শৈল চক্রবর্তী ও অহীভূষণ মালিকও৷
ছোটদের জন্য যাঁরা কার্টুন আঁকার চিন্তাভাবনা রূপায়িত করেছেন, তাঁদের মধ্যে ‘সুফি’ অন্যতম৷ আসল নাম নরেন্দ্রনাথ রায়। রাজনৈতিক কার্টুন আঁকা হাতেখড়ি, পরে ছোটদের জন্য অজস্র কার্টুন, কার্টুন স্ট্রিপ করেছেন শুকতারা, সন্দেশ, কিশোর ভারতী, ও শারদীয়া গণশক্তির ছোটদের পাতায়৷ ছোটদের দুষ্টুমি, মজা করার চেষ্টা, এ সব কার্টুনের মধ্যে ধরে রেখেছেন তিনি৷
বর্ষীয়ান কার্টুনিস্ট অমল চক্রবর্তী আজও ‘অমল আলো’য় উদ্ভাসিত৷ ইনিও ছোটদের জন্য কার্টুন ও কার্টুন স্ট্রিপ করেছেন সন্দেশ ও আরও নানা পত্রপত্রিকার পাতা৷ অমলের ছোটদের জন্য আঁকা কার্টুনে একটা বিষয় ফুটে উঠেছে, তিনি বর্তমান জীবনের জটিলতা ছোটরা কিছুটা অনুমান করে নিক, সেটাও চেয়েছেন৷ রেবতীভূষণের কয়েকটি কার্টুনেও সেটা বোঝা যাচ্ছে৷ অর্থাৎ কার্টুনিস্টরা বুঝতে পারছেন ছোটরা আসলে ছোট নয়, তারা তাদের দৃষ্টিতে বড়দের অসঙ্গতিগুলোকে আবিষ্কার করে ফেলে৷
দুই প্রয়াত কার্টুনিস্ট ও লেখক সুকুমার রায়চৌধুরী ও শতদল ভট্টাচার্য ছোটদের জন্য অল্পস্বল্প কার্টুন এঁকেছেন৷ সুকুমার রায়চৌধুরীর আঁকা ‘মহানগরীর রূপকথা’, ধারাবাহিক কার্টুন-কাহিনি ‘যুগান্তর’-এর পাতায় প্রকাশিত হয়েছিল’৷ কার্টুনে চিত্রকাহিনি পরিবেশন করে ইতিমধ্যেই পরিচিত নাম দিলীপ দাস ও জুরান নাথ, তবে তাঁদের চিত্রগত কাহিনিতে খানিকটা একঘেয়েমি এসে যাচ্ছে৷ দিলীপ দাসের কার্টুন চরিত্র ‘হুলো’কে কয়েকটি পত্রপত্রিকার পাতায় দেখা যায় বেশ কিছুকাল ধরে, ছোটদের কাছে তার কাজ অজানা নয়৷ কার্টুনে চিত্রকাহিনি পরিবেশন করতে গিয়ে তিনি নারায়ণ দেবনাথকে অনুসরণ করে চললেও, নিজস্ব একটা পরিমণ্ডল গড়ে তুলতে পেরেছেন৷ ইদানিং একটি দৈনিকের ছোটদের পাতায় পাশ্চাত্য ভঙ্গিতে কার্টুন স্ট্রিপ আঁকছেন তমাল ভট্টাচার্য৷ চরিত্রের নাম গুবলে, শিল্পীর আঁকা চমত্কার হলেও বিষয়বস্ত্ততে চমত্কারিত্বের ছাপ নেই৷ নতুনদের মধ্যে ছোটদের জন্য ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অনামী পত্রিকায় শুভজিৎ, বিষয়বস্ত্ততে বৈচিত্র্য আনার প্রয়াস রয়েছে তার মধ্যে৷
দেবাশীষ দেব অভিজ্ঞ শিল্পী, ছোটদের জন্য বই ও পত্রপত্রিকায় সরস অলংকরণ করে থাকেন প্রচুর, কিন্ত্ত ছোটদের জন্য কার্টুন আঁকতে তাঁকে সেভাবে দেখা যায়নি৷
অশোক সাধু, সুদর্শন মুখোটি, মানবসাধনা বিশ্বাস, প্রবীর সামন্ত, এ সব নাম ছোটদের কাছে অচেনা ঠেকবে, কারণ খুব অল্প সময়ের জন্য এঁরা ছোটদের জন্য কার্টুন-কাহিনি এঁকেছিলেন, অনেক দিন ধরে এঁদের কাজ চোখে পড়ছে না৷ ছোটদের পত্রপত্রিকার স্থায়িত্ব কমে আসাও এর একটা কারণ৷
বাংলাদেশের বিখ্যাত কার্টুনিস্ট ‘রনবী’র নামে এখানে বিশেষ ভাবে উল্লেখ করা দরকার৷ ‘রনবী’র প্রকৃত নাম রফিকুন নবী, ‘টোকাই’ তাঁর সৃষ্ট বিখ্যাত কার্টুন চরিত্র৷ ছন্নছাড়া, সমাজ-সংসার থেকে ভেসে যাওয়া একটি ছোট ছেলে, বলা যায় পথশিশু, তার চেনা-অচেনাকে কেমন করে দেখে, কী ভাবে দেখে, তাই নিয়ে নবীর এই স্ট্রিপ কার্টুন৷ শিশুশ্রম বিশেষ করে অনুন্নত দেশগুলির শিশুদের সুন্দর জীবন থেকে কী ভাবে বঞ্চিত করে, সেই কঠিন বিষয়কে পরিহাসের ভঙ্গিতে ছবিতে বুঝিয়েছেন তিনি৷ ছোটদের জন্য লঘু পরিহাসের মাধ্যমে বড়দের ব্যঙ্গদর্শন৷
বিদেশে, বিশেষত ইউরোপে ছোটদের বইয়ের অলংকরণ, ছোটদের জন্য কার্টুন, এ সব নিয়ে যে বিশাল বর্ণময় জগৎ ছড়িয়ে রয়েছে, আমাদের ছোট পরিধির মধ্যে তার নাগাল পাওয়া ভার, তবু সীমিত সুযোগের মধ্যে এখানকার শিল্পীদের আন্তরিক প্রয়াস এখনও টিকে আছে, এটাই আশার কথা৷