আমাদের জানা একমাত্র বাংলা কার্টুনচিত্রী, যিনি রাজনৈতিক কার্টুন আঁকতেন বলে সরকারি চাকরি থেকে বরখাস্ত হয়েছিলেন। নরেন্দ্রনাথ রায় কম্যুনিস্ট পার্টির পত্রিকা স্বাধীনতা-য় কার্টুন আঁকতেন, তাই হাওড়া স্কুল বোর্ড তাঁকে চাকরি থেকে ছাঁটাই করে। নরেন্দ্রনাথ কার্টুন এঁকেছেন প্রধানত ‘সুফি’ ছদ্মনামে। তাঁর অন্য অন্য ছদ্মনাম শ্রীমতী, প্রমীলা রায়, সঞ্জয়, শ্রীগুপ্ত, বিরিঞ্চি ইত্যাদি।
নরেন্দ্রনাথ কার্টুনের পত্রিকা প্রকাশ করেছেন প্রথমে রঙ্গব্যঙ্গ নামে, পরে নাম বদলে ব্যঙ্গজগৎ। তিনি কার্টুন আঁকা শেখানোর স্কুল বানিয়েছিলেন। কার্টুন আঁকা ছাড়া তিনি রচনা অলঙ্করণের কাজও করেছেন।
নরেন্দ্রনাথ কার্টুন এঁকেছেন অনেক পত্রিকায়। দৈনিক সংবাদপত্র, সাময়িকপত্র, ছোটদের পত্রিকা, খেলার কাগজ, মহিলা পত্রিকা, সিনেমা পত্রিকা। আমরা যে-ক’টির নাম জানতে পেরেছি : স্বাধীনতা, যুগান্তর, গণশক্তি, দৈনিক ও মাসিক বসুমতী, সচিত্র ভারত, যষ্টিমধু, সরস কার্টুন, প্রহরী, সচিত্র তোমার জীবন, জলসা, মঞ্চকথা, সংগীতিকা, খেলার মাঠ, স্টেডিয়াম, মেয়েদের কাগজ, মহিলা, সন্দেশ, শুকতারা, কিশোর ভারতী, শিশুসাথী। স্বাধীনতা পত্রিকায় ধারাবাহিক কার্টুন প্রকাশিত হয়েছে ‘কৌতুকী’ শিরোনামে।
স্বাধীনতা পত্রিকায় ‘কৌতুকী’ শিরোনামে প্রকাশিত কার্টুনগুলি থেকে কয়েকটি নিয়ে একটি সংকলন বেরিয়েছে। স্বাধীনতা : সুফির কার্টুন : ঘটনাবহুল ৬০ দশকে স্বাধীনতা-য় প্রকাশিত (১৯৬০-৬২) কার্টুনের পুনঃপ্রকাশ। প্রকাশক গ্রন্থমেলা, প্রকাশকাল ১৯৯১।
বইটিতে ‘প্রাসঙ্গিক কথা’য় নরেন্দ্রনাথ লিখেছেন, “স্কুলে পড়ার সময়ে ‘স্বাধীনতা’ পত্রিকার ছোটদের পাতা ‘কিশোর সভা’র সদস্য হই। সে সময়ে ‘কিশোর সভা’র পাতায় কয়েকটি কার্টুন প্রকাশিত হয়। সেই সূত্রে ‘স্বাধীনতা’ পত্রিকার সঙ্গে যোগাযোগ হয়। ‘কিশোর সভা’ ছাড়া অন্য কয়েকটি পত্রিকাতেও এ সময় কিছু কার্টুন এঁকেছি। এ সব কার্টুন নিছক হাসির। ষাট সালে স্বাধীনতা পত্রিকার বিশিষ্ট সাংবাদিক ও লোকসংস্কৃতিবিদ অরুণ রায় আমাকে স্বাধীনতা পত্রিকায় রাজনৈতিক কার্টুন আঁকতে অনুপ্রাণিত করেন। এর আগে রাজনৈতিক কার্টুন আঁকা সম্পর্কে আমার কোন ধারণা ছিল না। কার্টুনের ড্রয়িং,
তার বিষয়বস্তু নির্বাচন এবং তির্যক প্রকাশভঙ্গি, সব কিছুই ছিল অজানা। অরুণদা দিনের পর দিন
এ ব্যাপারে আমাকে নানা ভাবে সাহায্য করেছেন। তিনিই আমার কার্টুন আঁকার চোখ খুলে দিয়েছেন। তাঁরই আগ্রহ ও উৎসাহে ষাট দশকে স্বাধীনতার পাতায় নিয়মিত ছোট-বড় রাজনৈতিক ও হাসির কার্টুন আঁকতে শুরু করি। কংগ্রেস-শসিত পশ্চিমবঙ্গে সে সময়ে বামপন্থী রাজনীতির সপক্ষে কিছু বলা বা করায় ছিল ভীষণ বাধাবিপত্তি। তাই অরুণদাই আমাকে ‘সুফি’ নামটি দেন। যদিও এ ছদ্মনাম আমাকে বিপত্তি থেকে বাঁচাতে পারেনি। সুফি ছাড়া আরও কয়েকটি ছদ্মনাম নানা কারণে এ সময় ব্যবহার করেছি। যেমন বিনি, বিরিঞ্চি, সঞ্জয় ও প্রমীলা রায়। প্রথম দিকের আঁকা ছবিতে তাই ড্রয়িং দুর্বল, ও চিন্তাভাবনাতে দৈন্য রয়েছে। তবু সে সময় কংগ্রেস-শাসিত পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ও সামাজিক অবিচার ও নীতিহীনতাকে কার্টুনের মাধ্যমে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। যা একালের রাজনীতি সচেতন সাধারণ মানুষের কাছে আদৃত হবে।” (১১ জানুয়ারি, ১৯৯১)
/p