শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়ে কার্টুন

এবারের বিষয়মুখ : শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এখন আলোচনার বিষয়। এ বিষয়ে তিনটি কার্টুনেরই শিল্পী গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর। প্রথম কার্টুনটি গগনেন্দ্রনাথের প্রথম ব্যঙ্গচিত্র সংকলন ‘বিরূপ বজ্র’-এ রয়েছে। ‘বিরূপ বজ্র’ প্রকাশিত হয় ১৯১৭-য়।

প্রথম, ব্যঙ্গচিত্রের শিরোনাম ‘বিদ্যার কারখানা’, ইংরাজিতে Cramming Machine।

 

Cartoon Pattor Two _Images 11a

ছাত্ররা হাতে বই নিয়ে সিংহদ্বার দিয়ে প্রবেশ করছে একটি কারখানায়। বিদ্যার কারখানায়। কারখানার সিংহদ্বারের মাথায় মস্ত বড় একটি ঘড়ি। সময়কালের চিহ্ন। সিংহদ্বারের বাঁপাশে বেরবার পথে রয়েছে কারখানার বড়-বড় চিমনি। কারখানার চিহ্ন। চিমনি দিয়ে ধোঁয়া বেরচ্ছে। দুটি চিমনির মাথায় ফেজ ও টুপি-পরা দু’জন মানুষ দাঁড়িয়ে। দুটি প্রধান ধর্মের চিহ্ন। এঁরা পড়ুয়াদের প্রবেশ ও প্রস্থান তদারকি করছেন। কারখানার প্রবেশপথে লেখা ‘ইন’, বেরবার পথে ‘আউট’। যে-পথ দিয়ে পড়ুয়ারা বেরিয়ে আসছেন, সেখানে বড়-বড় আকারের মোটা-মোটা কয়েকটা বই। বইগুলির মধ্যে দিয়ে নিষ্পেষিত হয়ে বেরিয়ে আসছে ছাত্ররা। সে গ্রন্থের নিষ্পেষণে ছাত্ররা অধিকাংশই চ্যাপটা। দু’-একজন অক্ষত অবস্থায়, গুরুভার টেক্সটবুকের চাপ সহ্য করে বেরতে পেরেছে।

কারখানায় বেরবার পথের পাশে একটি গম্বুজে বসানো রয়েছে একটি টোপর। টোপরের নিচে আঁকা চাঁদ ও তারা। তারার গায়ে লেখা বি.এ.। দুটি অর্থে, ব্যাচেলর অফ আর্টস, স্নাতক, গ্র্যাজুয়েট এবং বিয়ে, বিবাহ। কারখানার এই অক্ষত গ্র্যাজুয়েট ছাত্ররা বিয়ের বাজারে দামি পাত্র হিসেবে বিবেচিত।

‘বিরূপ বজ্র’ প্রকাশিত হবার পর সেই সময়কার নাম-করা পত্রিকা ‘ভারতী’তে আলোচনা বের হয়— “বিশ্ববিদ্যালয়ের সিংহদ্বার খোলা; দলে-দলে বলিষ্ঠ ও স্বাস্থ্যসুন্দর যুবক ছাত্র ভিতরে ঢুকিতেছে— তাহারাই বঙ্গের ভবিষ্যৎ আশা ভরসা। ভিতরে বিদ্যার বিরাট কারখানা— উপরে কর্তৃপক্ষ পাহারায় নিযুক্ত। চিমনি দিয়া ধূম বাহির হইতেছে। প্রকাণ্ড গ্রন্থ-যন্ত্র পুরাদমে চলিতেছে এবং তাহারই কঠোর চাপে আষ্টেপৃষ্ঠে থেৎলাইয়া বাঙ্গালার ভবিষ্যৎ শিবরাত্রির সলতেরা যখন বাহির হইয়া আসিতেছে, তখন তাহাদের আর সেই জোরালো গড়ন ও সুশ্রী চেহারা নাই; তাহাদের কাহারও দেহে ধুতি-চাদর— বোধহয় কেরানি; কাহারও পরনে চোগা–চাপকান-সামলা— নিশ্চয়ই উকিল; কেহ হাত-পা ছড়াইয়া পপাত ধরণীতলে— সম্ভবত পঞ্চত্বপ্রাপ্ত।”

দ্বিতীয় ও তৃতীয় কার্টুন-দুটি গগনেন্দ্রনাথের অন্য একটি ব্যঙ্গচিত্র সংকলন ‘নবহুল্লোড়’-এর। প্রকাশকাল ১৯২১।

 

Cartoon Pattor Two _Images 12a

দেশে তখন অসহযোগ আন্দোলন। কংগ্রেসের নাগপুর অধিবেশন (১৯২০) থেকে কলকাতায় ফিরে চিত্তরঞ্জন দাশ অসহযোগ আন্দোলনের নেতৃত্বে। অসহযোগের উদ্দীপনায় ব্যবহারজীবীরা আদালতে, চাকুরেরা সরকারি অফিসে যাওয়া বন্ধ করেছেন। চিত্তরঞ্জন চাইলেন ছাত্ররাও ত্যাগ করুক স্কুল-কলেজ। তাদের উদ্দেশে চিত্তরঞ্জন আবেদন করলেন— স্কুল-কলেজ পরিত্যাগ করো। পাঠ্যপুস্তক পুড়িয়ে ফেলো। ইংরেজের শিক্ষা চাই না। ছেড়ে দাও ঐ গোলামখানা। চিত্তরঞ্জনের আবেদনে দেখা গেল দেশের শিক্ষায়তন প্রায় ছাত্রশূন্য।

বিশ্ববিদ্যালয়ে আলোচনার ঝড় উঠল। ছেলেরা শিক্ষায়তনে আসে না। অনেক আবেদন-নিবেদনেও ছাত্রদের শিক্ষায়তনে আনা যাচ্ছে না। তাদের সংখ্যা দিনের পর দিন কমছে।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর তখন স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। তিনি চিত্তরঞ্জনের নীতির বিরোধী। তাঁর অভিমত, ছাত্রদের রাজনীতি থেকে দূরে থাকাই ঠিক।

 

Cartoon Pattor Two _Images 13a

কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের ফিরিয়ে আনতে স্যার আশুতোষ ছাত্রদের উদ্দেশে এক বক্তৃতায় বলেন, “যদি তোমরা সকলে বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করিয়া যাও, যদি শিক্ষকেরা সকলে এ বিশ্বমন্দির ত্যাগ করে, আমি হতোদ্যম হইব না, একাকী এই বিশ্ববিদ্যালয় রক্ষা করিব, একাকী এই মন্দিরে বাংলার ভবিষ্যৎ বংশের জন্য অপেক্ষা করিব।”

এই পরিপ্রেক্ষিতে প্রবাসী‎‎ পত্রিকায় পাশাপাশি প্রকাশিত হয় গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের এক জোড়া ব্যঙ্গচিত্র (জ্যৈষ্ঠ ১৩২৮) প্রবাসী-তে ব্যঙ্গচিত্রটির টীকা ছিল, ‘বিজাতীয় শিক্ষায় আগুন লাগাও’। ‘নবহুল্লোড়’-এ বদলে হল, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে অগ্নিযোগ— Man proposes fire’। গগনেন্দ্রনাথ আশুতোষের ভূমিকাকে তুলে ধরেছিলেন ‘সামাল সামাল’ উল্লেখ করে। এ ব্যঙ্গচিত্রটি ও ‘নবহুল্লোড়’-এ নাম বদলে হয় ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে জলযোগ, God Disposes— Sweets’।

সূত্র : কমল সরকার, রূপদক্ষ গগনেন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রভারতী সোসাইটি, কলকাতা ১৯৮৬।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *