কার্টুন-চিত্রকর আর কে লক্ষ্মণ-এর খুব নামডাক ভারতের কার্টুনচিত্রের জগতে। কার্টুন এঁকেছেন ইংরেজি কাগজেই। তাঁর কার্টুন নিয়ে বানানো একটা বই ‘ব্রাশিং আপ দি ইয়ারস: আ কার্টুনিস্ট’স হিস্ট্রি অফ ইন্ডিয়া: ১৯৪৭ টু দি প্রেজেন্ট’। লক্ষ্মণ নানা সময়ে যে-সব কার্টুন এঁকেছেন সে সব সাজিয়ে-সাজিয়ে তাঁর চোখে দেখা তুলিতে আঁকা ভারতের একটা ইতিহাস বানানো, দেখানো। ১৯৪৭ থেকে বর্তমান। বর্তমান মানে বইটি যে-বছর বেরোয়, অর্থাৎ ২০০৮। প্রায় ৩০০ পাতা জুড়ে অনেক-অনেক কার্টুন।
সেই সব কার্টুন থেকে কয়েকটি বেছে নিয়ে আমরা সাজাব এখন। এখনকার অর্থনীতি বুঝতে। মোদি-সরকার নোট বাতিলের অর্থনীতি বানিয়েছে, নগদ-টাকা-ছাড়া অর্থনীতি বানিয়েছে। আমরা তার সমালোচনায়, বিরোধিতায় লক্ষ্মণের কার্টুন নিজেদের মতো করে সাজিয়ে নেব। আগের আঁকা কার্টুনে এখনকার কথা পড়ে নেব।
সরকারের বানানো সব অর্থনীতিতে মোটামুটি দুটি পক্ষ থাকে, শাসক আর শাসিত। শাসকদের বড় অংশীদার হল পুঁজিপতি, পুঁজি-মালিক, পুঁজির বড় বিনিয়োগকারী, পুঁজির বড় মুনাফাদার। এরা আমাদের দেশের, বিদেশের। এরা সংস্থা, কোম্পানি, ব্যাঙ্ক। এরা প্রতিষ্ঠান। যেমন আন্তর্জাতিক অর্থ প্রতিষ্ঠান আইএমএফ, ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্ক ইত্যাদি। বিপরীতে শাসিতরা, গরিবরা গ্রামে, শহরে, চাষে, কারখানায়, বেচাকেনায়। সরকারের বানানো বেশির ভাগ অর্থনীতিই শাসকদের পক্ষে, পুঁজির পক্ষে। শাসিতদের বিপক্ষে, সাধারণ মানুষের বিপক্ষে।
লক্ষ্মণের কার্টুনের একটি চরিত্র ‘সাধারণ মানুষ’। লক্ষ্মণের দেওয়া নাম ‘কমন ম্যান’। তার সাথীর নাম সাধারণ মানবী। সাধারণ মানুষটি শুধু দেখেন, তার চোখ দিয়ে লক্ষ্মণ আমাদের দেখান। কিন্তু সে কোন কথা বলে না, কথা বলে, কথা শোনায় সাধারণ মানবী।
এই কটি কথা বলে লক্ষ্মণের কার্টুন থেকে আমারা বেছে-বেছে সাজিয়ে দিচ্ছি মোদি-সরকারের জারি-করা নোট-অর্থনীতিকে বুঝতে, বোঝাতে, সমালোচনা করতে, বিরোধিতা করতে।
কার্টুন ১
কমন ম্যান, সাধারণ মানুষের ঘাড়ে মাইল-ফলকের বোঝা চাপানো, চাপিয়ে যাওয়া। সরকার একটা করে নীতি বানায়, আর বলে এটা দেশের উন্নতির পথে মাইল-ফলক। যেমন এবার এই নোট বাতিলের অর্থনীতি, যার চাপে সাধারণ মানুষ জেরবার।
কার্টুন ২
ভারতের অর্থনীতি নির্ধারণে পুঁজিপতিদের বিরাট ভূমিকা, সব সময়ে। বিশেষ করে ১৯৮০-র দশকের মাঝামাঝি থেকে। যখন থেকে বিদেশি পুঁজির বিনিয়োগের জন্য, বিদেশি পণ্যের বাজারের জন্য ভারতের অর্থনীতি পুরোপুরি খোলা। ভারতের কৃষিনীতি, শিল্পনীতি, জমিনীতি, খনিনীতি ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিদেশি অর্থনীতি-সংস্থার কথাতেই চলা। এই কার্টুনে ভারতের একসময়ের প্রধানমন্ত্রী নরসিংহ রাও, আর অর্থমন্ত্রী মনমোহন সিং, যিনি আবার পরে প্রধানমন্ত্রীও। আন্তর্জাতিক অর্থ-প্রতিষ্ঠান আইএমএফ, ইন্টারন্যাশনাল মনিটারি ফান্ড থেকে ডলার ধার করা আর বানানো শিল্পনীতি বয়ে নিয়ে আসা দু-জন। দু-জনেরই হাত মোচড়ানো, মুচড়ে দিয়েছে আইএমএফ। প্রধানমন্ত্রী অর্থমন্ত্রীকে বলছেন, যদি কেউ জিজ্ঞেশ করে আমরা বলব, আমরাই আমাদের হাত মুচড়েছি। বিদেশি চাপ আড়াল করে বলা যে দেশের শিল্পনীতি এবং অন্যান্য নীতি সরকারেরই বানানো, বদলানো (মোচড়ানো) সাধারণ মানুষের কথা ভেবে।
কার্টুন ৩
এই কার্টুনে প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী চলেছেন ‘কোকাকোলা’র দেখিয়ে দেওয়া পথে। কোকাকোলা এক বিশাল ক্ষমতাবান বিদেশি কোম্পানি। কোকাকোলা নাম আঁকা আসলে প্রতীক হিসেবে। বিদেশি পুঁজির, পুঁজিবাদের প্রতীক হিসেবে। দেখাতে চাওয়া, পুঁজির দেখিয়ে দেওয়া পথে যেতে বলা। এই কার্টুনে লক্ষ্মণের বলতে চাওয়া কয়েকটি খুব জরুরি কথা আমাদের পড়ে নিতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী হাঁটছেন না, হামাগুড়ি দিয়ে চলেছেন। হামাগুড়ি দেওয়া অধীনতার চিহ্ন। বিদেশি পুঁজির কাছে অধীনতা। শুধু ওঁরা দু-জনই হামাগুড়ি দিচ্ছেন না, সঙ্গে নিয়ে নিয়েছেন ‘কমন ম্যান’কেও। সরকার কথায়-কথায় বলে, ‘এই নীতি সাধারণ মানুষের জন্য, তাদের ভালো করার জন্য’, যা এবারেও এই নোট-অর্থনীতির বেলাতেও বলা হচ্ছে। যে-জমির ওপর দিয়ে হামাগুড়ি দেওয়া, লক্ষ্মণ লিখে দিয়েছেন, ‘অর্থনীতির জমি, জমির অবস্থা’, ছবিতে দেখিয়েছেন তার অবস্থা বেশ খারাপ। জমি রুক্ষ, বালি আর কাঁটাগাছ, যা এখন ভারতের গ্রাম-অর্থনীতির হাল। আরও দুটি চরিত্র আছে কার্টুনটিতে। পিছনে-পিছনে চলেছে সরকারি বামপন্থী দলেরা। একই পথে, একই ভাবে। দেশের যে-যে রাজ্যে তাদের সরকারে আসা, থাকা, সেখানেও হামাগুড়ি দেওয়া, অথচ মুখে বলা সেই কথাটি, যা লক্ষ্মণ লিখে দিয়েছেন, ‘আমরা সাধারণ মানুষকে তার আর্থনীতিক স্বাধীনতা হারানো থেকে বাঁচাব’।
কার্টুন ৪-৫
গ্রামের ভিতরে ঢুকে পড়েছে বিদেশি পণ্য। প্রথম কার্টুনে বিদেশি পণ্যের নাম এঁকে দেখানো। দ্বিতীয় কার্টুনে দু-জন গ্রামবাসীর মধ্যে কথা লিখে বোঝানো। একজন গ্রামবাসীকে আর-একজনকে বলছেন, শুনছেন সাধারণ মানুষ। ‘আমরা দারুণ এগিয়েছি’, আর এ কথার সমর্থনে পর-পর কয়েকটি বিদেশি পণ্যের নাম বলা। এখনকার এই নোট অর্থনীতিতে এই কথাগুলি হবে ক্রেডিট কার্ড, ডেবিট কার্ড, পেটিএম, রুপে, ই-ওয়ালেট ইত্যাদি-ইত্যাদি।
কার্টুন ৬
বিদেশি পণ্য, বিদেশি দোকান, বড় দোকান শহরে। শহরের বাজারে, শহরের অর্থনীতিতে। লক্ষ্মণের কার্টুনে শহরের ফুটপাথে বিদেশি খাবারওয়ালার জাঁকজমকে ছোট খাবারওয়ালাদের কাহিল অবস্থা। তাকিয়ে দেখছেন সাধারণ মানুষটি। এই ছবিটিকে বুঝে নেওয়া আজকের নোট-অর্থনীতি দিয়ে। নোট-অর্থনীতি চাইছে নগদহীন অর্থনীতি, কার্ড-অর্থনীতি, টাকা ছাড়া কার্ড দিয়ে বেচাকেনা। এই অর্থনীতিতে শুধু তারাই থাকবে, যারা কার্ড-অর্থনীতিতে আছে, আসবে, বড়রা। হারিয়ে যাবে তারা, যাদের কার্ড-অর্থনীতিতে আসার ক্ষমতা নেই, যারা আস্তে পারবে না, ছোটরা।
কার্টুন ৭
এই কার্ড-অর্থনীতিতে, নগদহীন অর্থনীতিতে শুধু তারাই ক্রেতা যারা এই অর্থনীতিতে আসার ক্ষমতা রাখে। তাদের হাত-ভর্তি পণ্য। তাদের হাত খালি যারা কার্ড-অর্থনীতির বাইরে। কমন ম্যান আর কমন ওম্যান, সাধারণ পুরুষ আর নারী। দু-দলের পথ দু-দিকে, উলটোদিকে। লক্ষ্মণ সেভাবেই এঁকেছেন, বুঝেসুঝেই।
কার্টুন ৮
তবু সরকার ঘোষণা করবে সরকারের নীতি গরিব মানুষদের ভালোর জন্য। যেমন এখন প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী, সরকারের অন্যান্য মন্ত্রী বলে চলেছেন, এই নগদহীন অর্থনীতির ফলে নাকি গরিবদের, চাষিদের, শ্রমিকদের ভালো হবে। কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে, বিজ্ঞাপনে প্রধানমন্ত্রীর ছবি সেঁটে, রেডিওতে বক্তৃতা দিয়ে নিরন্তর এ কথা বলে যাওয়া। লক্ষ্মণের কার্টুনে সেই সময়কার প্রধানমন্ত্রী আর অর্থমন্ত্রীর পিছনে তাদের আঁকা অগ্রগতির ছবি। এঁকে টাঙিয়ে দেখানো। সামনে দর্শক আর শ্রোতা সাধারণ মানুষ। এখানে সাধারণ মানবীর মুখে কথা, ‘ধন্যবাদ মন্ত্রীমশাই, আমরা জেনে খুশি হলাম যে আমাদের এত ভালো হচ্ছে। চারপাশে দরিদ্র নগরবাসী। লক্ষ্মণের ভয়ঙ্কর ব্যঙ্গ, যে-ব্যঙ্গ এখন আবার করার।
কার্টুন ৯
এই কার্টুনে লক্ষ্মণ মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন শাসক আর শাসিতকে। একসময়কার প্রধানমন্ত্রী দেবগৌড়া আর সাধারণ মানুষকে। প্রধানমন্ত্রীর হাতে ডাণ্ডা। ডাণ্ডার গায়ে যা-ই লেখা থাক, আমরা এখন পড়ে নেব নোট বাতিলের ঘোষণা। ডাণ্ডার বাড়িতে সাধারণ মানুষের মাথায় আঘাত, ফুলে গেছে। নোট-অর্থনীতির ফলে সাধারণ মানুষের ন্যাংটো হয়ে যাওয়া, তার জামাকাপড় খুলে নেওয়া সরকারের। তার টাকা কেড়ে নিয়ে আটকে রাখা। এর সঙ্গে জড়িয়ে কাজ হারানো, বেচাকেনা হারানো, চাষ বন্ধ হয়ে যাওয়া, যাকে বলে সাধারণ মানুষকে পুরোপুরি নাঙ্গা করে দেওয়া।
কার্টুন ১০
লক্ষ্মণ বিষয়টাকে আরও এগিয়ে নিয়ে গেছেন। শহরের ফুটপাথ, দু-জন দরিদ্র ফুটপাথবাসী। একজন আর-একজনকে বলছে, ‘মূল্যবৃদ্ধি দুই সংখ্যায় বেড়েছে, তাতে আমার কিছু যায়-আসে না। যখন এক সংখ্যায় বেড়েছিল, আমি তখনই সব হারিয়েছি’। আমরা কার্টুনটিকে এখন এই ভাবে পড়ে নিতে পারি : ভারতের দরিদ্রদের হাতে অনেকদিন ধরেই টাকা নেই, এই নগদ-টাকা-হীন অর্থনীতিতে তাদের আর নতুন করে কীই-বা আসে-যায়।
কার্টুন ১১
তবু শাসকদের নানা সময়ে ঢং দেখানো। এখনকার ঢঙের নাম ‘ডিজিটাল ইন্ডিয়া’, ‘ক্যাশলেস ইন্ডিয়া’। লক্ষ্মণের কার্টুনে অন্ধ্রপ্রদেশের সেই সময়কার মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নাইডু, তাঁর ঢঙের নাম ‘সাইবার রাজ্য’। দরিদ্র মানুষের হাতে ল্যাপটপ তুলে দেওয়া। আমরা নাইডুর বদলে দেখি মোদি, ল্যাপটপের বদলে কার্ড।
কার্টুন ১২
লক্ষ্মণের কার্টুনে এবার সরাসরি মোদি। তখনকার গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী, এখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। যিনি প্রচার বানাতে দক্ষ। তাঁর প্রচারের ঠেলায় ‘ডিজিটাল ইন্ডিয়া’ ছাড়িয়ে গেছে আসল ভারতকে, দরিদ্র ভারতকে। লক্ষ্মণের কার্টুনে ভারতের মানচিত্র এঁকে দেখানো মোদির, যেখানে তাঁর প্রচারের ঠেলায় ‘উন্নত গুজরাত’ ছাপিয়ে গেছে ভারতকে। তেমনি এখন দেখানো ‘ডিজিটাল ইন্ডিয়া’কে, যা সত্যিকারের ভারতকে ছাপিয়ে আঁকা, আর তাঁর দলের লোকেদের ‘বাহবা, বাহবা’ উচ্চারণ। লক্ষ্মণ কার্টুন-চিত্রী। কার্টুনে আঁকা থাকে অনেক ইঙ্গিত, যা পড়ে নিতে হয়। মোদির পা মাটিতে নয়, উঁচু মঞ্চে।
কার্টুন ১৩
এমন আঘাতে মারা যেতে বসেছেন দরিদ্র ভারতবাসী, চাষি, শ্রমিক, কারিগর, দোকানদার। ‘সাধারণ মানুষ’ হারিয়ে যেতে বসেছে। লক্ষ্মণের কার্টুনে তারই ছবি। অবলুপ্ত প্রাণীদের যাদুঘরে এবার ঠাঁই হবে সাধারণ মানুষের। লক্ষ্মণের সাধারণ মানুষটি নিজেই বয়ে নিয়ে এসেছে তাকে টাঙিয়ে রাখার ফ্রেম। যাদুঘরের অধিকর্তা তখনকার প্রধানমন্ত্রী নরসিংহ রাও। তাঁর চারপাশে কাগজে লেখা তখনকার নানান সমস্যা। আমরা তো অন্য কিছু সেখানে পড়ে নিতেই পারি। দর্শকের ভাবার স্বাধীনতা। সাধারণ মানুষটি, শাসিত মানুষটি ছবির ফ্রেমটি এগিয়ে দিয়েছে শাসককেই, শাসকের অবলুপ্তির ইঙ্গিত দিয়ে, অবলুপ্তই ঘোষণা করে। যা শাসিতের স্বপ্ন, এবং বিশ্বাস।
কার্টুন ১৪
লক্ষ্মণের এই কার্টুনটি নিজেকে নিয়ে, নিজের কাজ নিয়ে। সাধারণ মানুষ, সাধারণ মানবীকে খবরের কাগজ পড়ে শোনাচ্ছেন। বলা হচ্ছে, মন্ত্রীদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে কথা না বলতে। তলায় লেখা, এটা আসলে কার্টুনচিত্রীদের প্রতি ঘুরিয়ে সরকারি হুমকি। যেমন এখনও। সরকারের, সরকারি দলের হুমকির মুখে কে নয়? সাংবাদিক, আইনজীবী, সমাজকর্মী, চলচ্চিত্রী, সাহিত্যিক, ছাত্র, শিক্ষক, সবাই। যারাই শাসকের সমালোচক, তারাই। এবং অবশ্যই কার্টুনচিত্রীর সরকারি হুমকি না-মানা, বরং উলটোটা। শাসকদেরই আঘাত করা। লক্ষ্মণের কার্টুনে তুলিকে ঝাড়ুর মতো করে আঁকা। ছবির বাঁদিকে কোণায় ওপরে সেই সাধারণ মানুষটি। তারই থেকে যাওয়ার কথা, শেষ পর্যন্ত।