কার্টুন-চিত্রী প্রমথ সমাদ্দার

 

_Jastimadhu pramotho self

প্রমথ সমাদ্দারের কার্টুনে হাতেখড়ি হয়েছিল সাপ্তাহিক শিশির পত্রিকায়। তিনি ছিলেন কমার্শিয়াল আর্টিস্ট। কলকাতার গভর্নমেন্ট আর্টস কলেজ থেকে পাশ করেছিলেন ১৯২৯ সালে। কমার্শিয়াল আর্টিস্ট হিসাবে তিনি খ্যাত হয়েছিলেন। পর-পর তিনটি বিজ্ঞাপন চিত্রের সর্বভারতীয় প্রতিযোগিতায় পুরস্কার পেয়েছিলেন। রঙ্গব্যঙ্গের পত্রিকা সচিত্র ভারত-এর বাংলা ও হিন্দি সংস্করণে প্রকাশিত তাঁর কার্টুন সারা ভারতের রসিক সমাজে তাঁকে বিখ্যাত করেছিল। ভারতের বিভিন্ন ভাষার পত্র-পত্রিকায় তাঁর কার্টুন ছাপা হত।

তবু দুঃখের সঙ্গে বলব, আমরা তার সঠিক মূল্যায়ন করতে পারিনি। যতটা তার পাওয়া উচিত ছিল, তার কতটুকুই বা আমরা দিয়েছি। শেষের দিকে এই মনোবেদনায় তিনি খুবই মর্মাহত হয়ে পড়েছিলেন— জীবনে নৈরাশ্য এসে গিয়েছিল।

(‘প্রমথ স্মরণে’, নীলরতন বন্দ্যোপাধ্যায়, যষ্টি-মধু, অক্টোবর-ডিসেম্বর ১৯৮০, সংক্ষেপিত)

 

_Cartoon Pattar_Pramatha's cartoon 5

_Cartoon Pattor Pramatha's Cartoon 6a

_Cartoon Pattor Pramatha's Cartoon 7a

_Cartoon Pattor Pramatha's Cartoon 8-a

 

রাজনৈতিক, সামাজিক, পারিবারিক, ব্যক্তিগত সব সমস্যাই তার কার্টুনের ভিতর দিয়ে ফুটে উঠত। আবালবৃদ্ধকে মাথা ঘামাতে হত না সেই কার্টুনের বক্তব্য বুঝতে। পাঠকের হয়ে তিনিই যেন খাটুনি খেটে দিতেন— এত সহজ ছিল তার কার্টুন।

প্রমথ সমাদ্দার ফিগার ড্রয়িং বিকৃত না-করে অ্যানাটমি-পারস্পেকটিভ যথাযথ রেখে পরিষ্কার ড্রয়িংয়ে কার্টুন করতেন। তার কার্টুনের ধারা পরবর্তী কার্টুনিস্টদের অনেককে প্রভাবিত করেছে।

১৯৩৬ সালে সচিত্র ভারত-এ কার্টুনিস্ট প্রমথর আবির্ভাব। পরবর্তী কালে ঐ পত্রিকার পরিচালকবর্গের বহুবার পরিবর্তন ঘটেছে, সম্পাদক পালটেছে, কিন্তু প্রমথর কার্টুন বরাবর সমৃদ্ধ করে গেছে সচিত্র ভারত-কে।

কলকাতা ছাড়াও দিল্লি, অন্ধ্র, মাদ্রাজ, বোম্বাই, বিহার, উড়িষ্যা, আসাম সব জায়গার কাগজেই তিনি কখনও freelance, কখনও staff cartoonist হিসাবে কাজ করেছেন। বম্বের Illustrated Weekly, কলকাতার Orient, দিল্লির Shankar’s Weekly, বিহারে প্রভাতী রশ্মি, মাদ্রাজের Sports and Pastime, Andhra Jyoti, কটকের দৈনিক মাতৃভূমি ইত্যাদি।

কলকাতার The Nationমহাজাতি-তে তিনি স্টাফ কার্টুনিস্ট হিসাবে অনেক দিন ছিলেন।

তিনি ১৯৭০-৭১ সালে কার্টুনের সঙ্গে সব সংস্রব ত্যাগ করলেন।

তার কন্যা বা অন্য আত্মীয়স্বজনরা বলেন, দারুণ অভিমানই এর কারণ। কী এমন অভিমান? স্বীকৃতি না পাওয়ার অভিমান, প্রতিভার যথার্থ মর্যাদা না পাওয়ার অভিমান।

শেষজীবনে কার্টুন ছেড়ে ক্যালেন্ডারের ছবি আঁকতেন। অল্পদিনেই তা ছেড়ে দেন। তার কন্যারা ও ভাইয়েরা বলতেন, দারিদ্র্যই তার ছন্নছাড়া প্রকৃতির কারণ হয়ে উঠেছিল।

(‘নির্জন কার্টুনিস্ট প্রমথ’, সাক্ষাৎকার নীহাররঞ্জন বিশ্বাস, অনুলেখন শতদল ভট্টাচার্য, যষ্টি-মধু, অক্টোবর-ডিসেম্বর ১৯৮০)

 

_Cartoon Pattar_Pramatha's cartoon 4

_Cartoon Pattar_Pramatha's cartoon 2

_Cartoon Pattar_Pramatha's cartoon 1a

ঢাকার স্কুলে যখন পড়ি, ক্লাসে পণ্ডিতমশাই নরঃ নরৌ নরাঃ পড়াচ্ছেন, আর আমি তার প্রতিমূর্তি আঁকচি। পণ্ডিতমশাই টের পেয়ে চড়-চাপড় কানমলা তো দিলেনই, উপরন্তু ক্লাস থেকে গেট আউট করে দিলেন। এই রকম প্রায়ই হত। স্কুল পালিয়ে রঙের বাক্স নিয়ে মাঠের দিকে গিয়ে গাছের কিংবা কুঁড়েঘরের ছবি আঁকতাম। এইভাবে শিল্পটাকে ক্রমেই বেশি ভালবাসতে আরম্ভ করলাম।

১৯২১ সালে ম্যাট্রিক পাশ করে কলকাতায় সিটি কলেজে আইএ পড়তে শুরু করলাম মামাবাড়ি থেকে। ছবি আঁকা চলছেই সঙ্গে। মামা সিটি কলেজের অধ্যাপক ছিলেন। উনি বরাবর বিলাতের প্রসিদ্ধ সাপ্তাহিক হাস্যকৌতুক পত্রিকা Punch কিনতেন। সে পত্রিকা দেখে কার্টুন আঁকবার একটা প্রবল ইচ্ছা হল। আইএ পরীক্ষায় প্রথম বার ডিগবাজি খেয়ে দ্বিতীয় বার পাশ করে ভাবলাম কী করি। বাবার অনিচ্ছাসত্ত্বেও গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুলে ভর্তি হলাম একদিন। টিচারের একটা বিদ্রূপ শুনে দেড় বৎসর ডুব মেরে বসে রইলাম, আবার ভর্তি হলাম কমার্শিয়াল সেকশনে ১৯২৬ সালে।

১৯২৯ সালে সার্টিফিকেট নিয়ে প্রসিদ্ধ আর্ট প্রেস-এ যুক্ত হলাম। আমার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা ছিলেন আর্ট প্রেস-এর জেনারেল ম্যানেজার। তার প্রচেষ্টায় ১৯৩৬ সালে একটি হাস্যকৌতুক সাপ্তাহিক পত্রিকা বার হল। এই পত্রিকায় আমার আশা— কার্টুন আঁকার সুযোগ জুটে গেল। ক্রমে কার্টুনিস্ট জীবন এসে গেল এবং বিভিন্ন পত্রিকায় কার্টুন ছাপা শুরু হল। কোন সম্পাদক ‘এ চলবে না’ বলে ফেরত দিতেন, কোন সম্পাদক ‘রেখে যান, দেখব পরে’ বলে বিদায় দিতেন। মূল্যের বিষয়ে ‘আমরা ২ টাকার বেশি দিতে পারব না,’ আবার ‘পয়সা-টয়সা মশাই দিতে পারব না’। আবার অনেক সম্পাদক ‘বাঃ, চমৎকার হয়েছে!’— ছবি দেখে হয়তো হাসতেই লাগলেন। যখন কোন সম্পাদক বলতেন, ‘চলবে না,’ তখন ভাবতাম ধ্যেস, কার্টুন আঁকা ছেড়েই দেব। আবার চমৎকার বললে উৎসাহ বেড়ে যেত। এই রকম তাঁতির মাকুর মতন সম্পাদক বাড়ি ঘুরে-ঘুরে জীবন কাটতে লাগল। হতাশ হলাম না। নিজের অক্লান্ত চেষ্টার ফলে একটু সুনাম পেলাম (?) এবং ভারতবর্ষের বহু পত্রিকার সঙ্গে যোগাযোগ হল। কিন্তু দুঃখের বিষয় এত খেটেও পেটে খিদের কোঁ-কোঁ ডাক চলতেই থাকত এবং এখনও সেই ডাক চলচে। বহু লোককে হাসিয়েছি, কিন্তু নিজে আর হাসতে পারলাম না। এই কথা বলে শেষ করি— কার্টুন নেশা করা চলতে পারে, পেশা করা চলতে পারে না।

(‘আত্মপরিচিতি’, প্রমথ সমাদ্দার, একালের কার্টুন, সম্পাদক কুমারেশ ঘোষ, ১৩৮৭)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *