প্রফুল্লচন্দ্র লাহিড়ী (১৯০০-৭৬)
বাংলার প্রথম এডিটোরিয়াল কার্টুনিস্ট
বাংলায় কার্টুনচর্চার বর্তমান অবস্থা দেখে ধারণা করা যাবে না যে একসময় কী তুমুল ভাবে এই শিল্পমাধ্যমটি উপস্থিত থাকত অধুনালুপ্ত পত্রপত্রিকায়। শুভেন্দু দাশগুপ্তের গবেষণার ফলে আমরা জেনেছি যে আজ অবধি বাংলা কার্টুন বেরিয়েছে এগারোটির মতো সংবাদপত্রে, পঞ্চাশটির মতো সাময়িকপত্রে। বাংলায় কার্টুন এঁকেছেন প্রায় একশো কুড়ি জন।
কালীঘাটের পট, বটতলার কাঠের ব্লকে ছাপার স্তর পার হয়ে ব্যঙ্গচিত্র প্রথম স্থান পেল ১৮৭২ সালে অমৃতবাজার পত্রিকায়। তারপর ১৮৭৪ সালে বসন্তক সাময়িকপত্রে।
সেই সব কার্টুনের অঙ্কনরীতিতে সফিসটিকেশনের অভাব লক্ষ করেছেন কোন-কোন সমালোচক। কিন্তু রাজনীতির অসাম্য ও সামাজিক অবক্ষয় যখন তির্যক ভাবে ধরা দিল গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের তুলিতে, তখন যেন বাংলা কার্টুনের একটা নিজস্ব বেঞ্চমার্ক তৈরি হল। পরবর্তী পর্যায়ে সতীশ সিংহ, বিনয় বসু ও যতীন সেনকে পেলাম। আরো নানা শিল্পীর অবদানে বাংলা কার্টুন সমৃদ্ধ হল।
এই প্রেক্ষাপটে আবির্ভাব ঘটল প্রফুল্লচন্দ্র লাহিড়ীর, যিনি পিসিয়েল ও কাফী খাঁ নামেও সমধিক পরিচিত।
“ঢাকা শহরে ১৯০০ সালে আমার জন্ম। লেখাপড়ায় ভালোই ছিলাম। ইতিহাসের ছাত্র হয়ে ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছিলাম। ছেলেবেলা থেকেই হাতের লেখা, ড্রয়িং আর মানচিত্র আঁকায় ক্লাসে প্রাইজও পেয়েছি। ঢাকা কলেজে ইতিহাস পরীক্ষায় আমার ম্যাপ দেখে বিদেশি অধ্যাপক র্যামসবোথাম লিখেছিলেন, This is the finest map I have ever seen drawn by a student.” লিখছেন প্রফুল্লচন্দ্র। (আমি, কুমারেশ ঘোষ সম্পাদিত একালের কার্টুন, প্রকাশকাল ১৯৬৭-৬৯)
পরে যখন একবার সাহেবের সাথে গোয়ালন্দ স্টিমারঘাটে দেখা হল তখন র্যামসবোথাম তাকে জানালেন, “প্রফুল্ল, তোমার সেই ছবি আমি দেশে নিয়ে গিয়ে আমার হলঘরের ম্যান্টলপিসের ওপর রেখে দিয়েছি।”
“ফেনী কলেজে গিয়েছিলাম ইতিহাস ও সিভিকস পড়াতে। লেখাপড়ায় ভালো হলে বুঝি মাস্টারই হওয়া যায়। তবে মনে সাড়া পেতাম না। শুধু সেই পুরানো সিলেবাস পড়াতে হবে বছরের পর বছর।”
ক্লাস নেবার ফাঁকে-ফাঁকে তিনি ডুবে যেতেন আঁকায়। খুব সুন্দর বেহালা বাজাতে পারতেন। সহকর্মী ও ছাত্রদের নিয়ে সংগীতচর্চা, ড্রামাটিক অ্যাসোসিয়েশনে নাটকের রিহার্সাল, এ সব নিয়ে সময় কেটে যেত। ফেনী কলেজের অধ্যাপক গোপাল হালদার তাঁর আঁকা ছবি দেখে বলে ওঠেন, “আপনি এক্ষুনি কলকাতা চলে যান। এখানে মাস্টারি করে কেন জীবন খোয়াবেন?”
প্রফুল্লচন্দ্র হেসে বললেন, “এ লাইনে পয়সা কোথায়?” উত্তরে গোপাল হালদার বলেছিলেন, “সে হবে, তবে সেটা কিছুদিন পরে হবে।”
ফেনীতে অধ্যাপনা করার সময়েই তার কার্টুন বেরোতে শুরু করেছিল শনিবারের চিঠি পত্রিকায়। প্রফুল্লচন্দ্রের প্রতিভা আকৃষ্ট করল সম্পাদক সজনীকান্ত দাসকে। তিনিও প্রফুল্লচন্দ্রকে কলকাতায় চলে আসার পরামর্শ দিলেন।
ঐ সময় শনিবারের চিঠি পত্রিকায় কার্টুন করতেন দীনেশরঞ্জন দাস ও হরিপদ রায়। এ ছাড়া শিল্পী বিনোদবিহারীর অগ্ৰজ শখের কার্টুনিস্ট চিকিৎসক বনবিহারী মুখোপাধ্যায় (১৮৮৫-১৯৬৫) কার্টুন এঁকেছেন ঐ কাগজে। (এঁকে দেখেই বনফুল অগ্নীশ্বর উপন্যাস লেখার প্রেরণা পান)। প্রফুল্লচন্দ্র ঐ পত্রিকায় একটা প্ল্যাটফর্ম পেয়েছিলেন, এ বার সাহস করে কলকাতায় চলে এলেন।
কলেজে অধ্যাপকদের বেতন ছিল যৎসামান্য। তবে কার্টুন আরো অনিশ্চিত এক জীবিকা। প্রফুল্লচন্দ্র সেই ঝুঁকি নিতে পেরেছিলেন। কলকাতার জনসমুদ্রে অবগাহন করে তিনি স্রোতের বিপরীতে সাঁতার কাটতে লাগলেন। লক্ষ্য ছিল কার্টুনিস্ট হিসাবে পায়ের তলায় মাটি খুঁজে পাওয়া।
“একটা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের আশায় চলে এলাম কলকাতায়। ১৯৩৩-এর ফেব্রুয়ারি। নতুন লাইন তো ধরলুম, পয়সা কোথায়? বন্ধুবর সজনীকান্তের শনিবারের চিঠিতে পাবলিসিটি চলতে লাগল। মাথা কুটে, মেসের ভাত খেয়ে চেষ্টা চলতে লাগল। দেখলাম, যদি অর্থাগম হয়, আছে বিজ্ঞাপনের ছবি। তাতেও রাজি। শেষে বিদ্যাসাগর কলেজে, রিপন কলেজে অধ্যাপনার কাজ খুঁজছিলাম। বন্ধুবর সজনীকান্ত দাস উপদেশ দিলেন, এ ভাবে দু-নৌকায় পা দিয়ে pioneering-এর কাজ হয় না। একটা নিয়ে কামড়ে থাকুন।”
অবশেষে যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্তের Advance কাগজে তাঁর কার্টুন বেরিয়েছিল ১৯৩৩ সালের ১১ নভেম্বর, Diogenes ছদ্মনামে। তৎকালীন শ্যামা হক মন্ত্রীসভা নিয়ে রচিত হল বিবিধ ব্যঙ্গচিত্র।
কংগ্ৰেস তখন ক্ষয়িঞ্চু পরিবারতন্ত্র নয়, তবে নানা দল ও উপদলের অভ্যন্তরীণ টানাপোড়েন লেগেই থাকত। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের নারায়ণ পত্রিকা যেমন ছিল, তেমনি ছিল জে এম সেনগুপ্তের Advance পত্রিকা। সুভাষচন্দ্রের ছেলেদের সাথে সেনগুপ্তের অনুগামীদের রেষারেষির ফলে কংগ্রেসের প্রচুর সভা পণ্ড হয়ে যেত সেই সময়।
“১৯৩৪ সাল সেটা, অমৃতবাজার পত্রিকায় আমার কার্টুন আরম্ভ হল, তারপর যুগান্তর-এ ১৯৩৭ সাল থেকে। কিন্তু পয়সা তেমন আসত না। সে সময় ইংরেজদের Statesman-এ শুধু Strobe-এর কার্টুন বের হত।”
অমৃতবাজার পত্রিকায় স্টাইলাইজড টানে স্বাক্ষর করতেন Piciel, যুগান্তরে তিনিই কাফী খাঁ, সম্রাট আকবরের বিখ্যাত পার্ষদের নামে।
প্রথমদিকে নিজের কার্টুনের ওপর ডেভিড লো-র সামান্য প্রভাব থাকলেও, আস্তে-আস্তে নিজস্ব স্টাইল তৈরি করেন। তুলি নয়, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ব্যবহার করতেন নিব। গগনেন্দ্রনাথের সার্থক উত্তরসূরি প্রফুল্লচন্দ্রের কার্টুন সংবাদপত্র-পাঠকদের এক নতুনত্বের সন্ধান দিল।
ত্রিশের দশকের বাংলা ও ভারতের রাজনীতির মূল আকর্ষণ ছিলেন মহাত্মা গান্ধি, জওহরলাল নেহরু, মহম্মদ আলি জিন্নাহ, সুভাষচন্দ্র বসু, এ কে ফজলুল হক, সরোজিনী নাইডু, নাজিমুদ্দিনের মতো ব্যক্তিত্ব। যেহেতু ভারত তখন পরাধীন, তাই ব্রিটিশ মন্ত্রীসভার সদস্যরা, বড়লাট ও বিভিন্ন প্রদেশের গভর্নররাও থাকতেন সংবাদের শিরোনামে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ছিলেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী নেভিল চেম্বারলেন, উইনস্টন চার্চিল, জার্মান নাৎসি নেতা হিটলার, ইতালির একনায়ক মুসোলিনি, ফ্রান্সের দ্য গল, মার্কিন রাষ্ট্রপতি রুজভেল্ট- এমন সব ব্যক্তিত্ব। সকালবেলায় খবরের কাগজ খুললেই চোখে পড়ত প্রফুল্লচন্দ্রের রেখায় ঐ সব কুশীলবদের নানা কাণ্ডকারখানা।
ইতিহাসের শিক্ষক ছিলেন বলেই সমকালীন রাজনীতির ঘটনা বিশ্লেষণ করতেন অভ্রান্ত ভাবে। চার্চিলকে আঁকতেন গোলগাল বুলডগের মতো। গান্ধিজিকে দেখাতেন রোগা চাষির মতো, হাতে লাঠি ও কোমরে ঝোলানো ট্যাঁকঘড়ি। ফজলুল হক একবার বলেছিলেন, একশো জওহরলালকে আমি পকেটে পুরে রাখতে পারি। আবেগপ্রবণ ঐ মানুষটি কৃষক প্রজাপার্টির নেতা হিসাবে বাংলায় মুসলিম লিগকে ঠেকিয়ে রেখে কংগ্রেসের সাথে কোয়ালিশন সরকার গঠন করতে চেয়েছিলেন ১৯৩৭ সালে। শেষে কংগ্রেসের ছুঁতমার্গে বিরক্ত হয়ে লিগের সঙ্গে মন্ত্রীসভা গঠন করতে বাধ্য হন। কার্টুনে দেখা গেল, বিশালবপু ফজলুল হকের চাপকানের বিভিন্ন পকেট থেকে খোকা-জওহরলাল উঁকি দিচ্ছেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসি বাহিনী যখন মস্কোর ৪০ মাইলের মধ্যে এসে সোভিয়েত প্রতিরোধে আটকে গেল, তখন যোসেফ স্টালিন বললেন বুকের রক্ত থাকতে জার্মানদের এক ইঞ্চিও এগোতে দেবেন না। পিসিয়েল কার্টুন করলেন, রুশ জনগণ হাতে হাত দিয়ে এক সুউচ্চ প্রাচীর তৈরি করেছে এবং তার মাথার ওপর মুখ বাড়িয়ে স্বয়ং স্তালিন।
যুদ্ধের সময় ভারতের স্বাধীনতা বিষয়ে আলোচনার জন্য বৃটিশ মন্ত্রীসভার লেবার পার্টির সদস্য স্যর স্ট্যাফোর্ড ক্রিপসের নেতৃত্বে এক প্রতিনিধি দল পাঠানো হয় ভারতে। দিল্লিতে ক্রিপসের প্রস্তাব নিয়ে আলোচনার পরে কংগ্রেস সহ অন্যান্য দল তা প্রত্যাখ্যান করে। মহাত্মা গান্ধি ক্রিপস প্রস্তাবকে postdated cheque on a crashing bank হিসাবে অভিহিত করেন। পিসিয়েল আঁকলেন ক্রিপস সাহেব সমাদর করে একটি চেক গান্ধিজির হাতে তুলে দিচ্ছেন এবং গান্ধিজি মুখ ঘুরিয়ে হাত তুলে অসম্মতি জানিয়ে লাঠি হাতে কক্ষত্যাগ করছেন। গান্ধিজির নোয়াখালি পরিক্রমা, বেলেঘাটায় অবস্থান, অনশন ও সত্যাগ্ৰহ প্রভৃতি নিয়ে তাঁর কার্টুন কাব্যিক মহিমা স্পর্শ করেছিল।
১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্ট অমৃতবাজার পত্রিকায় পিসিয়েলের কার্টুনটির উপজীব্য ছিল পলাশীর যুদ্ধের পর থেকে বৃটিশ সিংহের বলীয়ান হয়ে ওঠা ও ধারাবাহিক ঘটনাক্রমের মধ্য দিয়ে হাড়-জিরজিরে ও বিধ্বস্ত অবস্থায় পলায়ন।
গান্ধিজির মৃত্যুর পর যে-কার্টুনটি তিনি করেছিলেন তা ধ্রুপদী পর্যায়ে উন্নীত হয়েছিল।
দেশের স্বাধীনতার পর শুরু হল নতুন চ্যালেঞ্জ। তৈরি হল নতুন শাসকগোষ্ঠী।
খাদ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল সেন তাঁকে নিয়ে কার্টুন করলে মোটেই প্রফুল্ল হতেন না। সেই চরম খাদ্যসংকটের দিনে তিনি নির্বাচনে হেরে যান। কার্টুনে দেখা গেল চালের বস্তার নিচে চাপা পড়েছেন প্রফুল্লবাবু।
বিখ্যাত চিকিৎসক তথা বাংলার মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায় মুমূর্ষু পশ্চিমবাংলার বুকে স্টেথো লাগিয়ে পরীক্ষা করছেন, এমন কার্টুনও করা হয়েছিল। প্রফুল্লচন্দ্রের গুণমুগ্ধ বিধানচন্দ্র অনেক সময় কার্টুনের ওরিজিনাল চেয়ে পাঠাতেন।
চণ্ডী লাহিড়ীর ভাষায়, “পিসিয়েল পেয়েছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, তৎসহ সমগ্র গান্ধি এবং সুভাষচন্দ্রের কাল। তৎসহ স্বাধীন ভারতবর্ষের অনেকগুলি বৎসর।”
পঞ্চাশের মন্বন্তর, বিয়াল্লিশের ভারত ছাড়ো আন্দোলন, আজাদ হিন্দ ফৌজ, দাঙ্গা ও দেশভাগ তাঁর কার্টুনের উপজীব্য হয়েছে।
পুরানো যুগান্তর ও অমৃতবাজার পত্রিকার পাতা উল্টালে বোঝা যাবে কী ভাবে তিনি কার্টুনের মাধ্যমে ইতিহাসের ধারাভাষ্য পরিবেশন করেছেন।
বাংলার লোককথা, রামায়ণ-মহাভারতের অনুষঙ্গ, প্রবাদ-প্রবচন– এই সব উপাদানের তুখোড় ব্যবহার তাঁর ব্যঙ্গচিত্রগুলিকে অন্য মাত্রা দিত।
শুধু রাজনৈতিক কার্টুন নয়, তিনি অনবদ্য স্ট্রিপ কার্টুনের স্রষ্টা। ১৯৩৬ থেকে অমৃতবাজার পত্রিকায় প্রতি মঙ্গলবার উঁকি দিত ‘খুড়ো’। এক সিন্ধুঘোটকের মতো গোঁফওয়ালা প্রৌঢ়ের জীবনের দৈনন্দিন অসঙ্গতি নিয়ে মজাদার উপস্থাপনা।
“পাঠকের দরবারে আমি হাজির করেছি আমার মানসপুত্র খুড়োকে। প্রায় তিন দশক ধরে তাকে দেখে লোকের ভালো লেগেছে।”
বিরলকেশ মস্তকে সামনের দিকে ঝুঁকে একগোছা চুল, অগোছালো চেহারা, ধুতি অনেক সময়েই কাছাখোলা, পারিপার্শ্বিকের চাপে নাজেহাল খুড়ো আর. কে লক্ষ্মণের কমনম্যান আসার অনেক আগে মানুষের সাথে যোগাযোগের সেতু তৈরি করেছিল।
“খুড়োকে যখন তৈরি করলাম তখন তাঁর কাঁধে চাদর, গায়ে বেনিয়ান, কোঁচানো ধুতি, পায়ে তালতলার চটি। খুড়োর গিন্নির গায়ে ভারি সেকেলে গয়না। পরে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে খুড়ির বেশবাস পরিবর্তন করতে হল। খুড়ির শাড়ি পরার ধরন পাল্টাতে হল, গহনার ভার হাল্কা হয়ে এল। কিন্তু তাদের বয়স একই রইল, মাথায় পাকা চুলের সংখ্যাও বাড়েনি। কিন্তু সমসাময়িক পরিস্থিতির সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে তাদের যা যা সমস্যা হচ্ছিল তাতেই পাঠকমহল কৌতুক উপভোগ করার উপাদান পেয়ে যাচ্ছিলেন। সময়ের ক্রমবিবর্তনের সঙ্গে-সঙ্গে মানুষের জীবন ক্রমশ যান্ত্রিক হয়ে যাচ্ছে। সেই যান্ত্রিকতার সঙ্গে জীবনকে মেলাতে গিয়ে খুড়ো দেখছে সে কতখানি মুশকিলে পড়েছে।”
১৯৪০ সাল থেকেই অখিল নিয়োগী (স্বপনবুড়ো) সম্পাদিত যুগান্তরের ছোটদের পাতা ছোটদের পাততাড়িতে লম্ফঝম্ফ শুরু করল শেয়াল পণ্ডিত। বোকা কুমির ও ধূর্ত শেয়ালের নানা মজাদার কাণ্ডকারখানা অবলম্বনে পাঁচ-ছয় কলাম ব্যাপী স্ট্রিপে থাকত হরেন ঘটকের ছড়া ও কাফী খাঁর ড্রয়িং। এর পর তুষারকান্তি ঘোষের উৎসাহে রবিবারের পাতায় নিয়মিত কমিক্স বা চিত্রকাহিনি শুরু করলেন। রামায়ণ-মহাভারতের ঘটনা ও চরিত্রের সন্নিবেশ ঘটিয়ে মজাদার ও কিম্ভুত পরিবেশ সৃষ্টিতে তাঁর জুড়ি ছিল না। তাঁর উল্লেখযোগ্য চিত্রকাহিনি হল মাস্টারবাবু, ট্রলিবাবু, রিকশাওয়ালা, মহাভারতের কথা, সবজান্তা রাজা, ভীমের গল্প, কুম্ভকর্ণের কাণ্ড, মহাভারতের বনপর্ব, দুই বোকার গল্প। তারিফ জানিয়ে বহু চিঠি আসত সংবাদপত্রের দপ্তরে।
ছোটদের জন্য তিনি বেশ কিছু বই লিখেছিলেন। তাঁর আঁকায় লেখায় সমৃদ্ধ ‘ছবি কথা’ বইটিতে পাতায় পাতায় ছবি এঁকে বুঝিয়েছিলেন কী ভাবে রেলইঞ্জিন কাজ করে, মোটরগাড়ি চলে বা এরোপ্লেন ওড়ে। দেশের মনীষীদের জীবন নিয়ে লিখেছেন সুভাষ-আলেখ্য, দধীচির অস্থি, সত্যের সন্ধানে, In Search of Truth.
শিশুসাথী পত্রিকায় নিয়মিত কার্টুন ফিচার সাজিয়েছেন, মালিক নরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের অনুরোধে কার্টুন করেছেন সচিত্র ভারত পত্রিকায়।
প্রফুল্লচন্দ্রের জীবনের একটি অনালোকিত দিক হল আ্যনিমেশান ফিল্মে তাঁর অবদান। “ফিল্ম কার্টুনের জন্য চেষ্টা করলাম কালী ফিল্ম-এর প্রিয়নাথ গাঙ্গুলীর কাছে। বাহাদুর নামে একটা ছবির পরীক্ষাও করেছিলাম সে সময়। আরো শুনেছিলাম নিউ থিয়েটার্সের একটা কার্টুন ফিল্মের পরীক্ষা চলছে। পরে সেটা Pea Brothers নামে বোম্বাইতে প্রদর্শিত হয়, বোধ হয় ভারতে তৈরি প্রথম কার্টুন ছবি।… কালী ফিল্মে একটা জিনিস বের করেছিলাম। গানের লেখার ওপর Jumping Ball, আর এর সাথে গান। কিন্তু আমাদের না আছে যন্ত্রপাতি, না আছে কোন গ্যাজেট, তাই জিনিসটা খুব শুদ্ধ হয়নি।”
বাংলায় বিজ্ঞাপনজগতে পিসিয়েলই প্রথম কার্টুনকে ব্যবহার করেন। এমপি জুয়েলারস, ঢাকেশ্বরী বস্ত্রালয়, প্রিয়গোপাল বিষয়ী, কুকমী গুঁড়োমশলা, সিরোলীন রোচের কাফ সিরাপ, সিজারস সিগারেট প্রভৃতি পণ্যের জন্য তৈরি করেন বিজ্ঞাপন যার লেটারিং, ক্যাপশন, কনসেপ্ট ও আর্টওয়ার্ক সবই তাঁর নিজের। সিজার্স সিগারেটের বিজ্ঞাপন ‘আপনি কি হারাইতেছেন আপনি জানেন না’ এখনো প্রৌঢ়দের মনে আছে। ছবিতে দেখা যেত সিগারেটে সুখটান দিয়ে মৌজে চলেছেন এক ভদ্রলোক, পেছনে একটি ষাঁড় তেড়ে আসছে।
প্রখ্যাত শিল্পী দেবাশীষ দেব লিখেছেন, “খুব ছোটবেলায় একটা বিজ্ঞাপনের কথা আমি আজও ভুলিনি যেটা মাঝে-মধ্যেই পত্রপত্রিকায় ছাপা হত। ছবিটা ছিল একজন এলোচুলের দজ্জাল গিন্নির, যিনি তার পছন্দের মাথার তেলটি না আনার জন্য কর্তার ওপর ভয়ানক চোটপাট করছেন। অথবা আরেকটি ছবি, আবার সেই মোটাসোটা মহিলার যিনি রান্নাঘরের মধ্যে কুরুক্ষেত্র বাধিয়ে ছেড়েছেন কারণ কর্তা তার একান্ত প্রিয় গুঁড়োমশলাটি বাজার থেকে আনেননি।”
এক অননুকরণীয় কৌণিক রীতিতে লেটারিং করতেন পিসিয়েল। চণ্ডী লাহিড়ী মনে করতেন, “আজকের কম্পিউটারের যুগে জন্মালে নিজের লিখনশৈলীর পেটেন্ট নিতে পারতেন। তাঁর ক্যালিগ্ৰাফির খাতা দেখার সুযোগ হয়েছিল আমার। প্রতিটি অক্ষরে চমক ছিল।”
আ্যনিমেশান ফিল্ম নিয়ে কাজ করতে গিয়ে মোহভঙ্গ হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু আ্যনিমেশান নিয়ে নিজস্ব পরীক্ষানিরীক্ষার ফসল তাঁর ‘কাফিস্কোপ’। পিসিয়েলের ঐ উদ্ভাবন প্রকাশিত হয়েছিল শিশু সাহিত্য সংসদ থেকে। একটি ৬ বাই ৩ ইঞ্চি মাপের হার্ডবোর্ডের আয়তাকার বাক্সের মধ্যে সমান মাপের তিনটি ক্ষুদ্র বই। অনেকটা ছোট আকারের তাসের প্যাকেটের মাপের। তাস সাফল করার মতো দ্রুতগতিতে পাতা উল্টে গেলেই ছবিগুলির ক্রম খুব দ্রুত পরিবর্তন হয়ে চলমান কার্টুন দেখার বিভ্রম তৈরি করত। বইগুলোর শিরোনামে লেখা KAFISCOPE : Animated cinema in picture pad : A Kafi Khan Enterprise. এক-একটি প্যাডে সামনে-পিছনে দুটি করে গল্প। প্রথমটিতে ছিল Long and Short, দ্বিতীয়টিতে Fish Story ও Milk Sucker এবং তৃতীয়টিতে The Swordsman ও Dog Fight. বর্তমানে Fish Story ও Milk Sucker বইটি পুনর্মুদ্রিত হয়েছে।
State Department Exchange Program-এ এডিটোরিয়াল কার্টুনিস্ট প্রফুল্লচন্দ্র লাহিড়ী রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধি হিসাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফর করেন। তাঁর গন্তব্য তালিকায় ছিল হাভার্ড, বোস্টন, ইয়েল ও হনলুলু বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানে বিভিন্ন আলোচনা ও মতবিনিময়ের কর্মসূচিতে অংশগ্ৰহণ করেন। পরিচয় হয় বিভিন্ন কার্টুনিস্টের সঙ্গে। তিনি ডিজনিল্যান্ডে গিয়ে মুগ্ধ হয়েছিলেন।
“ডিজনি স্টুডিওতে এক বাক্স কাফিস্কোপ নিয়ে গিয়েছিলাম। ছোট প্যাডের পাতার নড়াচড়ায় ছবিগুলো জ্যান্ত হয়ে ওঠে। ডিজনি সাহেবকে সেটা উপহার দিয়েছিলাম। সাহেব সেটা দেখে হাঁ করে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি বানিয়েছেন? Your animation is perfect.”
আমেরিকান কাগজগুলিতে তাঁর কার্টুন খুব গুরুত্ব দিয়ে ছাপা হয়, সঙ্গে কার্টুনিস্ট ও সৃষ্টির সংক্ষিপ্ত পরিচিতি। আমেরিকার লোভনীয় চাকরির প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে তিনি ফিরে আসেন দেশে। একটা আ্যড এজেন্সি চালানোর চেষ্টা করেছিলেন, অফিস ছিল বিখ্যাত স্টিফেন্স হাউসের ছ-তলায়।
“এত বড় একজন শিল্পী, এত দিন সুনামের সঙ্গে অমৃতবাজার পত্রিকা ও যুগান্তরে কাজ করলেও কিছু-কিছু শত্রুস্থানীয় লোকের অদৃশ্য সুতোর টানাটানিতে তাঁর ভাগ্যটা অন্যদিকে মোড় নিল,” লিখেছেন তাঁর পুত্র রজতবাবু। (রজতশেখর লাহিড়ী, পিতৃস্মৃতি, রঙ্গ ব্যঙ্গ রসিকেষু, ১৪০৭)
চণ্ডী লাহিড়ী ধ্রুবপদ (২০০২) পত্রিকায় ‘কার্টুনিস্টের চোখে দেখা’ নিবন্ধে আমাদের জানাচ্ছেন, “তিনি খুব অসম্মানের মধ্যে দিয়ে অমৃতবাজার পত্রিকা থেকে বিদায় নেন। মালিক তুষারকান্তি ঘোষ তাঁকে না জানিয়েই দিল্লির শংকরের সঙ্গে চুক্তি করেন এবং পিসিয়েলের চাকরি থাকতেই তাঁর ছবি বন্ধ করেন এবং শংকরের কার্টুন ছাপাতে শুরু করেন। তুষার-পুত্র তরুণকান্তি তখন মন্ত্রী। দিল্লির কর্তাদের নেকনজরে পুত্রকে রাখার জন্য, নেহরুর ঘনিষ্ঠ শংকরের ছবি তুষারবাবু ছাপতে থাকেন।… যারা প্রায়ই প্রশ্ন করেন, বাংলায় ভালো কার্টুনিস্ট হচ্ছে না কেন, তারা নিশ্চয়ই পিসিয়েলের এই করুণ পরিণতি থেকে জবাব পাবেন।”
পিসিয়েলকে আমরা ভুলেই যেতাম যদি না কার্টুন-গবেষক বিশ্বদেব গঙ্গোপাধ্যায়ের নিরলস প্রচেষ্টায় ‘রঙ্গ ব্যঙ্গ রসিকেষু’ পত্রিকার কাফী খাঁ সংখ্যাটি প্রকাশিত হত। তাঁরই উদ্যোগে ও সম্পাদনায় লালমাটি প্রকাশ করেছে ‘কাফী খাঁ’ সমগ্ৰ।
পিসিয়েলের করা পেনসিল স্কেচ, প্যাস্টেল, চারকোলের কাজ, জলরঙের ছবি ইত্যাদি চাক্ষুষ করার অভিজ্ঞতা তাঁর হয়েছিল। বিশ্বদেববাবুর মনে হয়েছিল যে কার্টুনিস্ট হিসাবে তাঁর প্রতিভার বিকাশ ঘটলেও তিনি ছিলেন প্রকৃতপক্ষে পূর্ণাঙ্গ এক শিল্পী।
১৯৭৫ সালের অগস্ট মাসে বিড়লা আর্ট গ্যালারিতে তাঁর জীবনকালে সম্ভবত প্রথম ও শেষ প্রদর্শনীতে নিজের আঁকা ছোট কার্টুনগুলিকে বড় করে এঁকেছিলেন পোস্টারের আকারে। সেগুলি এক-একটি চিত্রকর্ম হয়ে উঠেছিল। প্রদর্শনীর শেষ ছবিটি ছিল বহুপরিচিত খুড়ো, খাটো ধুতি আর ফতুয়া পরে উত্তরমেরুতে বসে আছে। পৃথিবী জলমগ্ন। শিল্পীর দূরদৃষ্টিতে অনাগত প্রলয়ের ইঙ্গিত।
ঋতুপর্ণ বসু
তথ্য ও ভাষা সহায়তা : বিশ্বদেব গঙ্গোপাধ্যায়, সম্পাদক, বিষয় কার্টুন
কৃতজ্ঞতা : বাংলার শিল্পী পর্ব ৬, প্রকাশক উদ্ভাস
রঙ্গ ব্যঙ্গ রসিকেষু পত্রিকা, কাফী খাঁ সংখ্যা, ২০০৩