আর কে লক্ষ্মণ জীবনের বেশির ভাগ সময়ে কার্টুন এঁকেছেন টাইম্স অফ ইন্ডিয়া পত্রিকায়। লক্ষ্মণের ‘কমন ম্যান’-এর এখানেই জন্ম, প্রতিষ্ঠা, খ্যাতি। এবং এখানেই তার বদল। তাকে পালটে দেওয়া।
টাইম্স অফ ইন্দিয়া-র ১৭৫ বছর উপলক্ষে একটি বই প্রকাশিত। জেস্ট ইন টাইম : আ কাভালকাড অফ কার্টুনস ওভার ১৭৫ ইয়ারস, ২০১৩। বইয়ের বিষয় পত্রিকায় ছাপা হওয়া কার্টুন।
কার্টুন আছে লক্ষ্মণের। লক্ষ্মণের কমন ম্যান। আর পরবর্তী কালে অজিত নাইনান ও নীলাভ ব্যানারজির।
সময় ধরে-ধরে লক্ষ্মণ কমন ম্যানের চেহারা একটু-একটু বদলেছেন। পোশাক বদলেছেন, অবস্থা বদলেছেন, কিন্তু অবস্থান বদলাননি, চরিত্র বদলাননি, ভূমিকা বদলাননি।
বইটিতে কমন ম্যান প্রথম এসেছেন ১৯৪৭ সালে।
শেষ এসেছেন ২০০৪ সালে। যদিও বলে রাখা দরকার যে বইটিতে সব কার্টুনের সময়কাল বলে দেওয়া নেই।
সঙ্গে কমন উওম্যান। কমন উওম্যানের কথা যখন এসে গেল, পরিচয়টা সেরে নেওয়া যাক। লক্ষ্মণের কমন ম্যান নিয়ে কথা হয়, কমন উওম্যান নিয়ে নয়। কমন ম্যান চুপচাপ, শুধু দেখেন, মুখে কোন কথা বলেন না। যে-কথা না বললেই নয়, সে কথা লক্ষ্মণ বলিয়েছেন কমন উওম্যানকে দিয়ে। সরাসরি শাসকের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে। আর কে লক্ষ্মণ কি তবে নারীবাদী?
১৯৪৭ থেকে ২০০৪, এই দীর্ঘ সময়কালে কমন ম্যানের অবস্থা ও অবস্থান বদলায়নি। তার দেখার বিষয়, দেখার অবস্থান পালটায়নি। সে ক্ষমতা ও ক্ষমতাসীনের বিপরীতে। সে আক্রান্ত, বিপর্যস্ত, অসহায়। যেমন নিম্নবর্গের ভারতবাসীরা। লক্ষ্মণ কমন ম্যানকে শুরু করেছিলেন সম্ভবত(?) মধ্যবর্গের/নিম্নমধ্যবর্গের প্রতিনিধি হিসেবে। পরে তাকে বদলে পালটে বানিয়েছেন নিম্নবর্গের প্রতিনিধি। এমন বদল ধরা যায় লক্ষ্মণের শেষ দিকের কার্টুনে। দুটি উদাহরণ রাখছি।
যে-কমন ম্যান সব জায়গায় ঘুরে বেড়ায়, দাঁড়ায়, দেখে, সে মাটিতে, চাপা পড়ে। অসহায়, বঞ্চিত, শোষিত। আর তার সামনে দাঁড়িয়ে হাসি-হাসি মুখে আনন্দিত সমস্ত রাজনীতিক দলের নেতারা। লক্ষ্মণ বিপরীতটা, দ্বন্দ্বটা বানিয়ে দিয়েছেন। এঁকে দিয়েছেন। কমন ম্যান আর দর্শক নয়, সে নিজেই আক্রান্ত।
আর কমন ম্যানের এমন পরিবর্তনের চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে গেছেন লক্ষ্মণ। যেখানে তাঁর নিজের হাতে তৈরি কমন ম্যানকে নিজেই ভেঙে দিয়েছেন।
কমন ম্যান বৃদ্ধ, দরিদ্র। বিখ্যাত চেক-কাটা কোটটি গায়ে নেই, ছেঁড়া, দেয়ালে টাঙানো। পরনের গেঞ্জি, ধুতি ছেঁড়া, সেলাই করা, তাপ্পি মারা। পায়ে পরিচিত পাম্প শু নেই, খালি পা, মুখে দাড়ি। ভাঙা চায়ের কাপ। সঙ্গে কমন উওম্যান। রিপু করা ছেঁড়া শাড়ি। ভাঙা ঘর, খালি মেঝে, জোড়াতালি দেওয়া দরজা। দরজার মাথায় মাকড়শার জাল। দরজার বাইরে ভারতের প্রায় সব রাজনৈতিক দলের নেতারা, ক্ষমতাসীনরা। কমন উওম্যান, কমন ম্যানকে জানাচ্ছেন, ওরা এসেছেন তোমার মত (ভোট) নিতে, আমাদের আর দেশকে বাঁচাতে। ব্যঙ্গের, পরিহাসের এমন ক্রূর চেহারা সচরাচর দেখা যায় না।
নিজের বানানো কমন ম্যানকে বদলে দিয়ে আর কে লক্ষ্মণ কার্টুন থেকে সরে গেলেন। তাঁর নির্বাক কমন ম্যানের মতো তিনি নিজেই নির্বাক হয়ে গেলেন।
তাঁর জায়গায়, তাঁর আঁকার জায়গায় টাইম্স অফ ইন্ডিয়া-র অন্য কার্টুনচিত্রীরা। অজিত নাইনান, নীলাভ ব্যানারজি। এঁদের কার্টুন লক্ষ্মণের কার্টুনের সঙ্গে এই বইতেই।
লক্ষ্মণের কার্টুন শাদা-কালোয়, অজিত নাইনানের রঙিন। লক্ষ্মণের রেখা তুলির টানে অতটা নিটোল, গোছানো, ঠিকঠাক মাপমতো নয়, স্বতঃস্ফূর্ত। রেখা নিয়ে নানা খেলা, আঁকাবাঁকা, কাটাকুটি, হাতে লেখা অক্ষর। অজিত নাইনানের রঙিন রেখারা নিটোল, মাপা, মাপজোক করা। লেখা টাইপে, আঁকা তুলিতে নয়, কম্পিউটারে। স্বতঃস্ফূর্ততা নেই। লক্ষ্মণের কার্টুনের রেখার টান তাঁর বয়েসের সঙ্গে-সঙ্গে বদলে গেছে, চোখে ধরা পড়ে। নাইনানের ক্ষেত্রে ধরা পড়বে না। মাথা থেকে আঙুল হয়ে, তুলি হয়ে কাগজে নয়। হাত হয়ে কম্পিউটার হয়ে প্রিন্ট আউট। কার্টুন আঁকায় আধুনিকতা। এমন সুযোগ হাতের কাছে থাকলেও লক্ষ্মণ তাতে হাত দেননি। নীলাভ ব্যানারজির কার্টুন রঙিন। ক্যাপশানে হাতের লেখা ও টাইপের ব্যবহার। নীলাভর কার্টুনও খুব গোছানো, মাপা, পরিসরের মধ্যে চরিত্রের ঠিকঠাক মাপ মেনে বসানো। নীলাভর কার্টুনকে কখনও-কখনও ছবি মনে হয়। মজার ছবি। মজার চরিত্রদের ছবি।
১৯৯০ দশক। বদলে যাওয়া, বদলে দেওয়া ভারত। সরকারের পিছনে সরে যাওয়া। সংস্থা পুঁজির সামনে চলে আসা। অবাধ বিদেশি পুঁজি, অনিয়ন্ত্রিত পণ্য উৎপাদন, মুক্ত বাজার। আধুনিকতা, অগ্রগতি, উন্নতির অন্য মানে। সংস্থা পুঁজি চালিত, প্রচারিত, প্রতিষ্ঠিত, নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতি-সমাজ-সংস্কৃতি-দর্শন এবং সব মিলিয়ে এক নতুন ‘মধ্যবর্গ’। বদলে যাওয়া মধ্যবর্গ। নিম্নবর্গের বিষয় বদলায়নি। নিম্নবর্গের বিষয় যারা উচ্চবর্গের কাছে পৌঁছে দিত, নিম্নবর্গের হয়ে কথা বলত, নিম্নবর্গের কথা মধ্যবর্গকে জানাত, নিম্নবর্গের বিষয়ের পাশে মধ্যবর্গকে দাঁড় করাত, সেই মধ্যবর্গই বদলে গেছে। তলার দিকের বিষয় এক রয়ে গেছে। মাঝখানে নতুন-নতুন বিষয় এসে মাঝখানে থাকাদের বদলে দিয়েছে, দিচ্ছে। এই বইটিতে, কার্টুন নিয়ে বইটিতে সেই বদলে যাওয়ার ছবি।
ছবি আঁকার ঢঙে। প্রযুক্তিতে বদল, ছবির বিষয়কে রাখার ঢঙে বদল। আর কে লক্ষ্মণের শাদা-কালো রঙের কার্টুনে কঠোর সমালোচনা, তীক্ষ্ণ বিদ্রূপ, হাসির বদলে ক্ষোভ। পরবর্তীদের রঙিন কার্টুনে ঠাট্টা ইয়ার্কি ফাজলামি ফিচলেমি। হাসি পায়, রাগ হয় না। মজা লাগে, বিরুদ্ধতা তৈরি হয় না।
বইটিতে একেবারে শেষ দিকে দুটি পাতা মিলিয়ে একটা বড় ছবি। বাঁদিকের শুরুতে শাদা-কালোয় আঁকা কমন ম্যান ‘স্বাধীনতা’ প্ল্যাকার্ড হাতে মাটিতে পড়ে আছেন। মাথায় পুলিশের লাঠির আঘাত। অনেক ছবি পেরিয়ে সেই কমন ম্যান ডানদিকের মাঝামাঝি রঙিন হয়ে সুইমিং পুলে ভাসছেন। ছবিটি এঁকেছেন নীলাভ। বাঁদিক থেকে ডানদিকে ছবির পথ ইচ্ছাকৃত, না কি আঁকার সুবিধায়, এমন প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে না।
যে-কথা অনেক ছবি পেরিয়ে আমাদের খুঁজে নিতে হল, এই বইটির শুরুর দিকের কয়েকটা পাতা পেরিয়ে একটা ছবিতে তার ইঙ্গিত। আমাদের এই লেখাটির শুরুতে একেবারে প্রথমে যে-ছবিটি রাখা আছে।
লক্ষ্মণের শাদা-কালো, ধুতি-পাঞ্জাবি, চেক কোটের কমন ম্যান বদলে যাচ্ছে পরবর্তী শিল্পীদের আঁকা রঙিন আধুনিক কমন ম্যান-এ। পায়ে দামি জুতো, জিন্সের প্যান্ট, চেক হাওয়াই শার্ট, চোখে সানগ্লাস, পকেটে যন্ত্র, যার সংযোগ কানে পৌঁছে গেছে। চোখ ঢাকা, কান ঢাকা নতুন কমন ম্যান। নতুন মধ্যবর্গ। যাকে সংস্থা পুঁজি নির্মাণ করেছে। যাকে পুঁজিবাদের প্রয়োজন। লক্ষ্মণের মৃত্যুর অঙ্কে আগেই তাঁর কমন ম্যানের মৃত্যু।