মেহেদী হক
Caricature is rough truth.
George Meredith
ক্যারিকেচার-এর বাংলা প্রতিশব্দ নেই৷ প্রতিশব্দ হিসেবে যেটা ব্যবহার করা হয়, তা হল ‘ব্যঙ্গচিত্র’৷ সমস্যা হল কার্টুনের বাংলা হিসেবেও একই শব্দ ব্যবহার করা হয়৷ কোন কিছুর প্রতিশব্দ কোন ভাষায় না পাওয়া গেলে বুঝে নিতে হবে সেই জিনিশ ওই ভাষাভাষীদের মধ্যে প্রচলিত না৷ ক্যারিকেচারের ক্ষেত্রে কথাটা হয়তো পুরোপুরি ঠিক না৷ উল্লেখযোগ্য না হলেও বাংলাদেশে ক্যারিকেচার হয়নি বলাটা ভুল হবে৷ আমরা এই লেখার শেষের দিকে সে প্রসঙ্গে যাব৷ তার আগে একটা কাজ চালাবার মতো ‘ক্যারিকেচারের ইতিহাস’ভিত্তিক খটোমটো কয়েক লাইন লিখে ফেলা যাক৷ এবং যেহেতু এই লেখাটি একটি সিরিয়াস টাইপ লেখা, তাই অতি অবশ্যই আমরা এর ভিতরে কিছু ভারি-ভারি ব্যাপার ঢোকানোর চেষ্টা করব, যেমন কোন ল্যাটিন শব্দের কোন অংশ থেকে ক্যারিকেচার নামটি এসেছে, এবং ষোড়শ বা সতেরো শতকের কোন শহরের কার হাতে এর উদ্ভব, ইত্যাদি৷ তবে এ সব কিছুর আগে ক্যারিকেচার কী বস্তু, তা আমাদের মতো করে একটু বুঝে নেয়া যাক৷ আমাদের এই সময়ে ক্যারিকেচার বলতে সাধারণত কোন মানুষের অতিরঞ্জিত (exaggerated) পোর্ট্রেটকেই বোঝায়৷ যদিও ব্যাপক অর্থে ধরলে আমরা বলতে পারি সেটা যে-কোন কিছুর অতিরঞ্জনই হতে পারে, এমনকী জড় বস্তুকে নিয়েও ক্যারিকেচার করা সম্ভব৷ সোজা ভাষায় ক্যারিকেচার আসলে ফর্ম-এর (আকার) অতিরঞ্জন৷ আর এ ক্ষেত্রে মাস্টার ক্যারিকেচারিস্টরা বার-বারই আমাদের সাবধান করে দিচ্ছেন যে সেটা অতিরঞ্জনই, বিকৃত (distortion) করা না৷ অর্থাৎ কোন কিছুকে এমন ভাবে টানাটানি করে একটা পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া যাতে সেটা একেবারে রিয়েলিস্টিক কিছুও না থাকে, আবার তাকে যেন সেই অবস্থাতে চেনাও যায়৷ চেনা যাওয়াটা এখানে অনেক গুরুত্বপূর্ণ৷ এমন ভাবে কোন কিছুকে উল্টেপাল্টে দেয়া হল যে মূল ব্যাপারটাই বোঝা গেল না, তা হলে সেটা আর যা-ই হোক ক্যারিকেচার না৷ এ বার কথা হল, মানুষ কবে থেকে এই জিনিসটা শুরু করল? এবং সেটা কেন? এর দরকারটাই বা কী?
প্যালিওলিথিক যুগের গুহাচিত্র। মানুষ ও পশুদের ক্যারিকেচারড ফর্ম লক্ষণীয়।
আসলে আমরা যদি ক্যারিকেচারের ওপরের সংজ্ঞাটা মেনে নেই, তা হলে বলতে হবে ক্যারিকেচারের ইতিহাস প্রায় মানুষের ইতিহাসের সমান বয়সী। কারণ গুহাচিত্রে আমরা যা দেখি, তা আর যা-ই হোক কোন ভাবেই রিয়েলিস্টিক ফটো-ফিনিশড ছবি না৷ মানুষ তাদের শিকার করার ঘটনাগুলিকে অতিরঞ্জিত করে আঁকত৷ মানুষ আর পশুগুলির ফিগারের ফর্ম আসল ফিগারের অতিরঞ্জন৷ অর্থাৎ ক্যারিকেচার৷ মানে কিনা এই ছবিগুলিতে মানুষের অবয়ব হুবহু না এঁকে তার ‘ভাব’টা (essence) ধরার চেষ্টা করেছে৷ মজার ব্যাপার হল, বর্তমানের আধুনিক চিত্রকলাও কিন্তু সেই একই দিকে যাচ্ছে৷ আধুনিক চিত্রকলায় ফর্মের সরলীকরণ (simplification) আর ভাবের অতিরঞ্জন (exaggeration), এই দুই দিকে জোর দিয়েই নিত্যনতুন গবেষণা চলছে৷ সেই দিক থেকে দেখতে গেলে আমরা কার্টুন-ক্যারিকেচারকে আদিম আর আধুনিকের একটা দারুণ ককটেল বলে চালিয়ে দিতে পারি৷ কারণ কার্টুন-ক্যারিকেচার এই দুইটা ব্যাপারের ওপরেই দাঁড়িয়ে আছে৷ এখানে সবচেয়ে জটিল ফর্মটাকে সবচেয়ে সহজে এঁকে ভেতরের ভাবটায় রঙ চড়িয়ে প্রকাশ করাটাই আসল মুন্সিয়ানা৷ (এ বারে ইতিহাস অংশে প্রবেশ করা যাক।)
বারোক যুগ ও আনিবেল কারাচ্চি
চিত্রকলার ইতিহাসে ষোড়শ শতকের দিকে মধ্য ইউরোপে একটি নতুন ধারা দেখা যায়৷ ধারাটির নাম ‘বারোক’ (Baroque)৷ বারোক পেইন্টারদের মূল বৈশিষ্ট্য ছিল তারা রোমান্টিক ঘরানা থেকে সরে এসে প্রকৃতির রূঢ় বাস্তবের কথা বলতে শুরু করেন৷ যেমন কোন একটা অসাধারণ নৈসর্গিক পেইন্টিং-এর কোণা দিয়ে একটা মড়ার খুলি এঁকে দিলেন। মানে হল, এই জীবন সুন্দর তা মানি, কিন্তু ভুলে যেও না একদিন মরতেও হবে৷ কিঞ্চিৎ ধর্মীয় ভাব-ঘেঁষা বারোক যুগের পেইন্টাররা তাঁদের পেইন্টিংগুলি যাতে মানুষ দেখেই তার মেসেজটা চট করে বুঝে ফেলে সেভাবে আঁকতেন, আর তাঁরা পেইন্টিং-এর মূল ভাবকে ‘অতিরঞ্জিত’ (exaggerated) করে আঁকতেন৷ এই বারোক যুগ নিয়ে এত কিছু বলার কারণ হল আমাদের ক্যারিকেচার বস্তুটার প্রাতিষ্ঠানিক জন্ম হয় একজন বারোক পেইন্টারের হাতে, তাঁর নাম আনিবেল কারাচ্চি (Annibale Caracci)৷ এই ইতালিয়ান পেইন্টার সর্বপ্রথম ক্যারিকেচার করা শুরু করেন বলে ধরা হয়৷ ক্যারিকেচারের ইতিহাসে কারাচ্চির সাথে চিত্রকলার ইতিহাসের আরো দুইজনের নাম উল্লেখ করা হয়। একজন স্বয়ং কারাচ্চির ভাই আগস্তিনো কারাচ্চি (Agostino Carracci), আরেকজন মহাপ্রতিভাধর বার্নিনি (Gianlorenzo Bernini)৷ বার্নিনি তিন-চার টানে মানুষের ক্যারিকেচার করে ফেলতে পারতেন৷ পাপাসির যুগে এই কারণে তাঁর বেশ কদরও ছিল৷ প্রথম দিকে ক্যারিচেকার এই ইটালি আর ফ্রান্সের একটা নির্দিষ্ট মহলের শিল্পবোদ্ধাদের মধ্যে আটকা থাকলেও অচিরেই গোটা ইউরোপে তা ছড়িয়ে পড়ে৷ দেখা যায় এই নতুন অদ্ভুত আর মজাদার মাধ্যমটির জনপ্রিয় হতে বেশি সময় লাগছে না৷ মজার ব্যাপার হল, কারাচ্চি ভ্রাতৃদ্বয় বা বার্নিনি-র অনেক আগেই মোনালিসার আর্টিস্ট লিওনার্দো দা ভিনচি ক্যারিকেচার শুরু করেছিলেন (এই লোক আসলে কিছুই ছাড়েননি!)। মানুষের চেহারার আসল ‘ভাব’ কী ভাবে অতিরঞ্জিত করে আঁকা যায়, তা নিয়ে বেশ কিছু স্টাডি তিনি করে গেছেন৷ এমনকী মানুষের হাসি কী ভাবে আঁকা যায় (সে সময় কথায়-কথায় স্মাইলি এঁকে ফেলাটা সহজ ছিল না), সেটা দেখতে তিনি মাঝে-মাঝে বন্ধুবান্ধবদের দাওয়াত দিয়ে তাদের কৌতুক শোনাতেন– উদ্দেশ্য, হাসি স্টাডি৷ আবার ইটালির পম্পেই নগরীতে তারও আগের কিছু গ্রাফিতি (দেয়ালচিত্র) ক্যারিকেচার পাওয়া যায়৷ অর্থাৎ কারাচ্চি পর্বের আরো আগে থেকেই ক্যারিকেচারের চল ছিল৷ সে যা-ই হোক, কারাচ্চি পর্বের পর-পর যাঁর নাম না-বললেই না, তিনি ব্রিটিশ দিকপাল আঁকিয়ে উইলিয়াম হোগার্থ৷ উইলিয়াম হোগার্থ-কে একই সাথে পশ্চিমা সিকোয়েনশিয়াল আর্ট বা কমিক্স-এর জনক বলেও ধরা হয়৷ উইলিয়াম হোগার্থের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক ছিল তিনি এই ধরনের ড্রয়িং অর্থাৎ ক্যারিকেচার বা কমিক বুক ঘরানার ড্রয়িংকে সামাজিক-রাজনৈতিক স্যাটায়ার হিসেবে ব্যবহার করা শুরু করেন৷ এর আগেও যে সেটা হত, তা আমরা জানি৷ কিন্তু এ বিষয়ে হোগার্থ ছিলেন সবিশেষ৷
আরেক বারোক যুগের শিল্পী অ্যাড্রিয়েন উট্রেখট-এর আঁকা পুষ্প ও করোটি
আনিবেল কারাচ্চি-র আঁকা ক্যারিকেচার
বার্নিনি-র আঁকা নিজের ক্যারিকেচার
আগোস্তিন কারাচ্চি-র কাজ
লিওনার্দো-র করা ক্যারিকেচার স্টাডি
দ্য বেঞ্চ, উইলিয়াম হোগার্থ
প্লাম্বপুডিং, জেমস গিলারি
হোগার্থের পর-পরই যার নাম বলতে হয়, তিনি জর্জ ক্র্যুকশ্যাঙ্ক (George Cruikshank)৷ এই ব্রিটিশ ক্যারিকেচারিস্টকে মর্ডান যুগের হোগার্থ বলেও ডাকা হত৷ ক্র্যুকশ্যাঙ্ক তাঁর ক্যারিকেচারগুলি শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে একেবারে নির্দয় ভাবে ব্যবহার করতেন৷ আঠারো শতকে এসে ব্রিটেনে মারি ড্যারিল আর জেমস লিগারি-র হাত ধরে ক্যারিকেচার আরো প্রসারিত হয়৷ আর সে সময় ফরাসি শিল্পী ওনোরে দোমিয়ে (Honore Daumier) এসে ক্যারিকেচারের সংজ্ঞাই যেন পালটে দেন৷ ফর্মের এমন ভাঙচুর তিনি করে দেখালেন, যা এর আগে ক্যারিকেচারিস্টরা ভাবতেও সাহস করেননি৷
ওনোরে দোমিয়ের-এর আঁকা ক্যারিকেচার
জর্জ ক্র্যুকশ্যাঙ্ক-এর আঁকা রাজা চতুর্থ জর্জ
দ্য আম্ব্রেলা, জর্জ ক্র্যুকশ্যাঙ্ক
ক্যারিকেচারের ইতিহাস লিখতে গেলে ফ্রান্স-এর এই দোমিয়েরদের যুগটাকেই প্রধান বলে মানতে হবে আর ক্যারিকেচারের এই ‘ফরাসি বিপ্লবে’র পুরোধা হিসেবে যাঁর নাম বলা হয়, তিনি ফরাসি আঁকিয়ে-কাম-ক্যারিকেচারিস্ট শার্ল ফিলিপঁ (Charles Philipon)৷ তিনি ‘লা কারিকাতুরা’ (La Caricature) নামে একটি রাজনৈতিক স্যাটায়ারিকাল ম্যাগাজিনই বের করেন৷ এবং সে সময়ের অনেক নাম-করা ক্যারিকেচারিস্ট (একটু আগে বলা দোমিয়ের-সহ) এই ম্যাগাজিনে কাজ করতেন৷ রাজতন্ত্রের ওই যুগে তিনি রাজা প্রথম লুই ফিলিপ-এর (Louis Philippe I) ক্যারিকেচার করেন৷ যাতে দেখা যায় রাজার মুখটা আস্তে-আস্ত একটা নাশপাতি হয়ে যাচ্ছে৷ ফ্রান্স-এ এর মানে হল মাথামোটা৷ ব্যস, সাথে-সাথে আদালতের শমন এসে হাজির। তত্ক্ষণাৎ গ্রেফতার হন এই ক্যারিকেচারিস্ট৷ ক্যারিকেচারের ইতিহাসের সাথে এই ফ্রান্সের রাজতন্ত্রের একটা বিরাট যোগাযোগ আছে বলে ধরা হয়৷ এ সময় প্রচুর প্রতিভাবান শিল্পী রাজতন্ত্রের খামখেয়ালিপনায় পড়ে বেকার হয়ে যান৷ সেই ক্ষোভ একে-একে রাজনৈতিক ক্যারিকেচারকে আশ্রয় করে ধীরে-ধীরে প্রকাশ পেতে থাকে৷ অর্থাৎ এ সময় পর্যন্ত ক্যারিকেচারের মূল বক্তব্য ছিল শুধুমাত্র রাজনৈতিক৷ সব কিছু পালটে গেল এসে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর৷
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও ক্যারিকেচার
উনিশ শতকে এসে খবরের কাগজে ক্যারিকেচার প্রকাশের হিড়িক পড়ল৷ আর এ বারে সেটা শুধু রাজনৈতিক স্যাটায়ার নিয়েই বসে থাকল না, তার সাথে প্রকাশ পেতে থাকল বিভিন্ন সেলিব্রেটির মজাদার সব ক্যারিকেচারও৷ যদিও তার মধ্যে রাজনৈতিক সেলিব্রিটিরাই প্রাধান্য পেতেন৷ আর বলাই বাহুল্য যে, সেলিব্রিটিরা সে সব দেখে সবাই মজা পেতেন না৷ তাই ঝামেলা এড়াতে ক্যারিকেচারিস্টরা বেশির ভাগ সময়েই ছদ্মনাম ব্যবহার করতেন৷ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর-পর ক্যারিকেচার যেন প্রিন্ট মিডিয়ার অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠল৷ রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তখন এমনকী ফটোগ্রাফের চাইতেও ক্যারিকেচারের চাহিদা অনেক বেড়ে গেল৷ বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রীতিমতো ক্যারিকেচার-বিপ্লব ঘটে গেল৷ সে সময়টাকে ক্যারিকেচারের রেনেসাঁ যুগ বললেও ভুল বলা হবে না৷ সে সময়ে আল হির্শফিল্ড, মিগুয়েল কোভারুবিয়াস-এর মতো ক্যারিকেচার-শিল্পীরা দেখালেন ক্যারিকেচার মানেই শুধু কারো চেহারা ভয়ানক করে আঁকা না, ক্যারিকেচার এমন রঙিন ও কুশলী ভাবে করা যায় যাতে যার ক্যারিকেচার করা হল, তিনি নিজেও ব্যাপারটা উপভোগ করতে পারেন৷ অর্থাৎ ক্যারিকেচার তখন তার নির্দিষ্ট গণ্ডির বাইরেও ছড়িয়ে গেল৷ বিভিন্ন ফ্যাশন ম্যাগাজিন, দৈনিক পত্রিকা, সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন ইত্যাদিতে একজন ক্যারিকেচারিস্ট তখন লাগবেই৷ একটা ব্যাপার লক্ষণীয় যে, সে সময় ফাইন আর্টস নিয়ে পাশ করেননি এমন ক্যারিকেচারিস্ট ছিল না বললেই চলে৷ মানে রীতিমতন আর্ট কলেজ থেকে পাশ-করা আঁকিবুকির ব্যাকরণ-জানেওয়ালারাই তখন এই কাজটা করতেন৷ কারণ একজন ক্যারিকেচারিস্টকে অবশ্যই প্রথমে একজন ভালো পোর্ট্রেট আর্টিস্ট হতে হবে, আগে জানা তারপর সেটা ভাঙা৷ সে যা-ই হোক হির্শফিল্ড, কোভারুবিয়াস ছাড়াও সেই সময়ের এমন দিকপাল ক’জন আঁকিয়ের মধ্যে আরো ছিলেন জন্মসূত্রে জার্মান-আমেরিকান কার্টুনিস্ট টমাস নাস্ট (Thomas Nast), স্যার ম্যাক্স বিয়ারবম (Sir Max Beerbohm) ইত্যাদি৷ ক্যারিকেচারের আধুনিক যুগ শুরুর আগে পর্যন্ত এই হল এর ছোটখাটো ইতিহাস৷
আল হির্শফিল্ড-এর আঁকা হিচকক-এর ক্যারিকেচার
মিগুয়েল কোভারুবিয়াস-এর কাজ
নিজের ক্যারিকেচার, টমাস নাস্ট
স্যার ম্যাক্স বিয়ারবম-এর কাজ