কার্টুন চিত্রকর সুধীর তৈলঙ্গ চলে গেলেন ৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৬৷ জন্ম ২৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৬০৷ রাজস্থান প্রদেশের বিকানির-এ৷
ইংরাজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর সুধীর স্বশিক্ষিত শিল্পী৷ ১০ বছর বয়সে তাঁর সংবাদপত্রে ছাপা হওয়া প্রথম কার্টুন৷ ১৯৮২-তে ২২ বছর বয়সে প্রথম পত্র-পত্রিকায় কার্টুন আঁকার চাকরি ইলাসট্রেটেড উইকলি-তে৷ তার পর নানা সময়ে নবভারত টাইমস্, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ডেকান ক্রনিকল, হিন্দুস্তান টাইমস্, টাইমস্ অফ ইন্ডিয়া, ইকনমিক টাইমস্, ফেমিনা, ফিল্ম ফেয়ার, শেষে এশিয়ান এজ।
সুধীরের কার্টুন নিয়ে প্রদর্শনী হয়েছে ১৯৮৬, ১৯৯৭, ২০০২, ২০১৪ সালে৷ ২০১৪-এর প্রদর্শনী ‘হেয়ার অ্যান্ড নাও: রাজিব টু মোদী’ আর্ট অ্যালাইভ গ্যালারিতে৷
কার্টুন নিয়ে তাঁর বই ‘ওয়ার্ল্ড অফ সুধীর তৈলঙ্গ’ (১৯৯২), ‘হেয়ার অ্যান্ড নাও: আ কালেকশন অফ পলিটিকাল কার্টুন’ (১৯৯৭), ‘সুধীর তৈলঙ্গ’স্ বিগ কার্টুন’ (২০০২), ‘নো, প্রাইম মিনিস্টার’ (২০০৯)৷ সুধীর তৈলঙ্গের কার্টুন নিয়ে, কার্টুনের বৈশিষ্ট্য নিয়ে নানা জন নানা মন্তব্য করেছেন৷
সুধীর সাহসী শিল্পী৷ তিনি সব সময়ে সমস্ত ধরনের কর্তৃত্ব, কর্তৃপক্ষ বিষয়ে গভীর সন্দিহান ছিলেন৷ তাঁর কার্টুনশিল্পী-জীবনে তিনি বার-বার কর্তৃত্বকে, রাজনীতিক ক্ষমতাসীনদের বিরোধিতা করেছেন৷
সুধীর সব সময়ে, একটি দিনের বড় রাজনীতিক ঘটনাকেই তাঁর কার্টুন আঁকার বিষয় নির্বাচন করতেন না৷ বরং সবাইকে চমকে দিয়ে, অবাক করে দিয়ে, সাধারণ মানুষের জীবনযাপনের প্রয়োজনীয় বিষয় নিয়ে আসতেন তাঁর কার্টুনে৷
ইন্দিরা-রাজীব শাসনকালের বিখ্যাত ব্যঙ্গচিত্রীদল ও নরসিংহ-লালু-মনমোহন শাসনকালের প্রকাশমান ব্যঙ্গচিত্রকরদের মধ্যে যোগসূত্র সুধীর তৈলঙ্গ৷ দুটি কালের শ্রেষ্ঠ উপাদানের প্রতিনিধি তিনি৷ সুধীর ঐতিহ্যশালী, কিন্ত্ত রক্ষণশীল নয়৷ সূক্ষ্ম, কিন্ত্ত আঘাত করতে পিছপা নয়৷ সুধীর তাঁর কার্টুনশিল্পী-জীবনে বার-বার বাঁক নিয়েছেন৷ বাঁক নেবার সাহস দেখিয়েছেন৷ নবভারত টাইমস্-এ হিন্দিতে আঁকা কার্টুন থেকে ইংরাজি ভাষার সংবাদপত্রে ইংরাজিতে আঁকা কার্টুন৷ সংবাদ-কার্টুন পাঠক-দর্শকের নিজের ভাষার সঙ্গে যুক্ত হয়ে থাকে৷ ফলে কার্টুনের ভাষা বদল খুব সহজ কাজ নয়৷
আবার হিন্দুস্থান টাইমস্ কিংবা ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস-এ সপ্তাহে ছ’ দিন ছোট পকেট কার্টুন আঁকা থেকে এশিয়ান এজ-এ প্রতি দিন সম্পাদকীয় বড় কার্টুন আঁকা৷
সুধীর আর কে লক্ষ্মণ-এর ‘কমন ম্যান’-এর মতো একটি কার্টুন-চরিত্র বানিয়েছেন৷ একজন সাংবাদিক, ঝোলাওয়ালা, একজন পরিদর্শক, তাঁর চারপাশের পৃথিবীর৷ চেহারাটি বানিয়েছিলেন তাঁর সাংবাদিক-বন্ধু, থুতনিতে ছাগলদাড়িওয়ালা সুশীলের চেহারার ঢঙে৷ আবার একদিন চরিত্রটিকে আঁকা ছেড়েও দিয়েছেন৷
সুধীর তৈলঙ্গের কার্টুন আঁকা শাদা-কালোয়, তুলি আর কালিতে৷ আবু আব্রাহাম, বিজয়ন, রাজিন্দর পুরির ঐতিহ্যে৷
২০১১-তে ছাপা হওয়া সুধীর তৈলঙ্গের একটি প্রবন্ধ ‘ডিসিডেন্ট ডিজাইন’ কার্টুন বিষয়ে একটি জরুরি রচনা৷ রচনাটিতে সুধীর লিখেছেন, রাজনীতিক কার্টুনই প্রতিবাদের একমাত্র প্রকৃত ভাষা৷ আমার মধ্যে সব সময়ে বিক্ষোভ তৈরি হতে থাকে৷ চারপাশে যা ঘটছে, তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ৷ আমার রাগকে বের করে দেবার ইচ্ছে জাগে৷ প্রকাশ করার প্রয়োজন বোধ হয়৷ আর কার্টুনই হল আমার পছন্দের অস্ত্র৷ কার্টুনের মধ্যে থাকা ব্যঙ্গ, যে প্রকাশিত মত, তা-ই হল একটি কার্টুনের হৃদয় আর আত্মা৷ আঁকার রেখা খুবই জরুরি৷ কিন্ত্ত বক্তব্যই হল কার্টুনের জাদু৷ তেমন শক্তিশালী আঁকা নয়, তাতেও একটা জরুরি বক্তব্য কার্টুনে থেকে যেতে পারে৷ কিন্ত্ত একটা দুর্বল বিষয়কে শক্তিশালী আঁকাও গ্রহণীয় করে তুলতে পারে না৷ কার্টুনে লেখা কথা আঁকা ছবির পরিপূরক৷ কিন্ত্ত কথা-না-থাকা কার্টুনই সেরা কার্টুন৷
সুধীর লিখেছেন, কার্টুন সংবাদপত্রের অলংকরণ নয়, সংবাদপত্রের প্রধান সংবাদগুলিতে প্রকাশিত বিষয়কে অলংকৃত করা বা বুঝিয়ে বলা, বুঝিয়ে দেখানো কার্টুনচিত্রীর কাজ নয়৷ কার্টুনচিত্রীর কাজ জনসাধারণের দুর্দশাকে প্রকাশিত করা৷
সুধীরের কথায় তিনি সাধারণ মানুষের নৈরাশ্যকে প্রকাশ করেন৷ তিনি নির্বাক চুপ করে থাকা মানুষের মুখপাত্র৷ তাদেরই স্বরকে আমার কার্টুনে ধরে রাখি৷ কার্টুন আঁকার ঢঙ, ধরন সময়ের সাথে-সাথে বদলে যায়৷ মতামতও বদলে চলে৷ আমি আমার কার্টুনকে সহজ, সোজাসুজি করে বানাই৷ আমি যেহেতু সাধারণ মানুষের হয়ে কথা বলি, আমার রেখার ভাষা সেই রকমই, যার সঙ্গে তারা নিজেদের যোগ খুঁজে পায়৷ অনেক বছর ধরে অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে স্বাভাবিকতাতেই রেখার নিজস্ব চরিত্র তৈরি হয়ে যায়৷ একজন কার্টুনচিত্রীর আঁকার ঢঙ বানিয়ে দেয় এই সব নির্দিষ্ট রেখারাই৷
২৫ বছর ধরে আমি যা কার্টুন বানিয়েছি, সে সব এখনও প্রাসঙ্গিক৷ এই প্রাসঙ্গিকতাটাই আমার কাছে একই সাথে মজার এবং ভাববার বিষয়৷ সামাজিক রাজনীতিক বিষয়, যা নিয়ে কার্টুন আঁকা, দুর্নীতি, বেকারত্ব, দারিদ্র, ক্ষুধা ইত্যাদি তো দশকের পর দশক ধরে একই রকম থেকে গেছে৷
সুধীরের মতে, আজকের দিনে কার্টুনকে সংবাদ-শিরোনামের, সংবাদপত্রের শিরোনামের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় থাকতে হচ্ছে৷ একটা কার্টুনের জীবন খুবই সংক্ষিপ্ত, ঠিকঠাক উপভোগ করার জন্যও সংক্ষিপ্ত৷ টেলিভিশন আর ইন্টারনেটের যুগে একটি সংবাদ তাত্ক্ষণিক, স্বল্পস্থায়ী৷ একটি কার্টুন ছাপা হবার আগেই পুরনো হয়ে যাচ্ছে৷ ফলে একজন কার্টুনচিত্রী এমন পরীক্ষার মুখোমুখি, যেখানে তার কার্টুনকে একটি সংবাদপত্রের শিরোনামের মৃত্যুর পরও জীবন্ত রাখতে হচ্ছে৷ নতুন ও চিন্তাশীল পাঠক-দর্শকের কাছে প্রয়োজনীয় ও উপযোগী হয়ে ওঠাই কার্টুনের একমাত্র কাজ৷ কার্টুনচিত্রীর সবচেয়ে বড় শিক্ষা কার্টুনের বিষয়কে সহজ হতে হবে, উপস্থাপনাকে সরল হতে হবে৷ কার্টুনচিত্রীকে অনেক আঁকতে হবে, অনেক পড়তে হবে, তার অনেক ধৈর্য থাকতে হবে৷
সুধীর তৈলঙ্গ পরিশ্রমী কার্টুনচিত্রী৷ একটি লেখায় বলেছিলেন, ২৫ বছরে ১০ জন প্রধানমন্ত্রীর কার্টুন আঁকা খুবই পরিশ্রমের বিষয়৷ আমি একটা কার্টুন আঁকতে ১০ ঘণ্টা সময় নিতাম৷ সহকর্মীদের বক্তব্য, কাজের দিনে সুধীরের সঙ্গে দেখা করা সহজ ছিল না৷ প্রায় ১০ ঘণ্টা কাজের শেষে সুধীর সন্ধে সাতটায় তার আঁকা জমা দিতেন৷ সুধীরের আঁকা কার্টুন নিয়ে একটি ঘটনা৷ তখন গণেশের দুধ খাওয়া চলছে৷ সুধীর কার্টুন এঁকেছিলেন গণেশ আইসক্রিম খাচ্ছে৷ একজন মহিলা গভীর রাতে সুধীরকে ফোন করে জানাল ৩ দিনের মধ্যে সুধীরের মৃত্যু হবে৷ ৩ দিন কেটে গেল, সুধীর তাকে জানালেন গণেশের রসবোধ মহিলাটির থেকে বেশি৷ আর একজন একই কারণে সুধীরের বিরুদ্ধে মামলা করে, লোকটি মামলায় হেরে যায়৷ সুধীর মজা করে জানান গণেশ চতুর্থীর দিনেই৷
সুধীরের নিজের কথায়, আমি একজন রাজনীতিক কার্টুনশিল্পী৷ গণতন্ত্রে একজন কার্টুনশিল্পীর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ৷ যে-কোন ক্ষমতাসীনের আমি বিরোধী৷ প্রতি দিন একটি করে দারুণ বিষয় ভাবা এবং আঁকা খুব সহজ কাজ নয়৷ কিন্ত্ত কাজটা সহজ করে দিয়েছে রাজনীতিক ব্যক্তিরা৷ তারা জনগণের জন্য পুরো সময় ধরে কাজ করে না, কিন্ত্ত কার্টুনচিত্রীর জন্য করে৷ দুর্দান্ত মন্তব্য৷
সুধীর তৈলঙ্গ শুধু সংবাদপত্রের জন্য কার্টুন আঁকেননি৷ তার বাইরেও এঁকেছেন সামাজিক দায়িত্ববোধে৷ সুধীর তাত্ক্ষণিক ক্যারিকেচার এঁকে ভূপালে গ্যাস-আক্রান্তদের জন্য টাকা তুলে দিয়েছেন৷ রাজস্থানের খরাক্লিষ্ট মানুষদের অর্থ সাহায্য করেছেন কার্টুন এঁকে৷ কপিল দেবকে নিয়ে আঁকা ৭ ফুটের ক্যারিকেচার নীলামে বিক্রি করে টাকা দিয়েছেন একটি শিশুদের জন্য প্রতিষ্ঠানে৷
সুধীরের কার্টুনের প্রতি দায়বদ্ধতার পরিসর সংবাদপত্রে আঁকার অনেক বাইরে৷ কার্টুনের প্রতি ভালোবাসায় তিনি কার্টুনচিত্রীদের নিয়ে তথ্যচিত্র বানিয়েছেন৷ কার্টুন প্রদর্শনী করেছেন, কার্টুন নিয়ে বক্তৃতা দিয়েছেন৷ কার্টুনশিল্পকে সংবাদপত্রের নিউজ রুমের বাইরে নিয়ে গিয়েছেন৷
সুধীরের কন্যা অদিতি জানিয়েছেন, সুধীর স্বপ্ন দেখতেন একটি কার্টুন মিউজিয়াম-এর৷ তিনি চেয়েছিলেন মিউজিয়ামে কার্টুনের ইতিহাস দেখাতে৷
সুধীর তৈলঙ্গের স্বপ্ন সফল করার দায় আমাদের৷ আমরা যারা কার্টুন আঁকি৷ যারা কার্টুন দেখি৷ যারা কার্টুন ভালোবাসি৷ যারা মনে করি কার্টুন একটি শিল্পকলা৷ একটি রাজনীতিক শিল্পকলা৷
এশিয়ান এজ-এ প্রকাশিত সুধীরের কার্টুন দেখার জন্য ক্লিক করুন এই লিঙ্ক-এ :
http://www.asianage.com/
আরও দেখুন :
http://www.creativegaga.com/